আমি বিয়ের পর যখন শ্বশুর বাড়িতে এলাম

,
দেখলাম পাশাপাশি তিনটি বাড়ির সাথে শাশুড়ি মায়ের কোনো কথা নেই।বুঝলাম প্রতিবেশিদের সাথে শাশুড়ির ঝগড়া।আমার তো শুনেই খারাপ লাগতে শুরু করল।আমি তখন নতুন বৌ।একটা ভয় ভয় করতে লাগল।সেই সঙ্গে একটা খারাপ ধারণাও তৈরি হলো শাশুড়ি সম্পর্কে।

বিয়ের আগে প্রত্যেকটা মেয়ের একটা ভয় ভীতি থাকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কেমন হবে এই নিয়ে।বিশেষ করে শাশুড়ি মানুষটা।বিয়েটা যখন দেখাশোনা করেই তাই মেয়ের বাড়ির লোকজন ছেলের সম্পর্কেই খোঁজ খবর নেয় বেশি।শাশুড়ি কেমন হবে এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা নেই এই ব্যাপারটা জানার পর থেকে শাশুড়ির প্রতি একটা ভয় কাজ করত সব সময়।কিন্তু শাশুড়ি মা আমার সাথে ঠিকঠাকই ব্যবহার করতেন।বুঝতে পারতাম না শাশুড়ি মা তো খুব একটা খারাপ না,তাহলে কেন প্রতিবেশিদের সাথে ঝগড়া?নিশ্চয়ই শাশুড়ি মায়ের কোনো উইক পয়েন্ট আছে।আমাকে জানতেই হবে সে কথা।কিন্তু সে ভাবে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি।

বিয়ের তিন মাস পর এদিকে নতুন বৌকে দেখার জন্য শাশুড়ি মায়ের দুজন আত্মীয়া বাড়িতে এলেন।শাশুড়ি মায়ের বাপের বাড়ির তরফের লোক।আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার শাশুড়ি মা।আমি প্রণাম করতেই ওনারা বললেন,

-রেণু দি,তোমার ছেলের বৌ তো বেশ সুন্দরী হয়েছে।

তারপরে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–শুধু দেখতে সুন্দর হলেই হবে না।কাজে কর্মেও সুন্দরী হতে হবে।রূপ ধুয়ে কেউ জল খাবে না কিন্তু।

শাশুড়িমা শুনে চুপ করে থাকলেন।কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।আমার একটু খারাপ লাগলো।বুঝলাম শাশুড়িমার বাপের বাড়ির লোক তো,তাই এমন কথা বলার সুযোগ পেল। সে যাইহোক, দুপুরে খেতে বসে ঘটল আর একটা ঘটনা।ওই দুজন আত্মীয়ার একজন বললেন,

–রেণু দির তাহলে তো কপাল খুলে গেল।দারুণ রান্না করেছে তোমার নতুন বৌ।

আমি তখন পাশেই দাঁড়িয়ে আছি।আমি অপ্রস্তুতে পড়ে বললাম,

–এ মা!না না।আমি রান্না করিনি।সব রান্না মা-ই করেছেন।

তারপর ওই আত্মীয়া বললেন,

–ও আমি ভাবলাম তুমিই রান্না করেছো।তা তুমি রান্না পার না?

–অল্প অল্প।

–রেণুদি তুমি এখনো হেঁশেল ঠেলছো?বয়স হচ্ছে তো!কোথায় বৌমার রান্না ভাত খাবে?

আমার শাশুড়িমা তখন হাসতে হাসতে বললেন,

–ঠিকই বলেছিস শোভা।তবে জানিস তো বৌমার রান্না ভাত খেতে হলে আগে বৌমাকে রান্না করে খাওয়াতে হবে।বৌমা খেয়ে বুঝুক আমরা কেমন রান্না পছন্দ করি।তা নাহলে ও বুঝবে কী করে?ওকে যদি এখন থেকেই রান্না করতে দিই তাহলে ও ওর মত করেই করবে।তারপর আমরাই আবার ভুল ধরে বলব এটার নুন বেশি হয়েছে,ওটাতে নুন কম হয়েছে। জানিস ভুল ধরতে সবাই পারে,কোনটা করলে ঠিক হবে সেটাই কেউ শেখায় না।

আমি তো ভাবতেই পারছিলাম না শাশুড়িমা এমন কথা বলবেন।ওনাদের তখন মুখটা একেবারেই চুন হয়ে গেছে।দেখলাম শাশুড়িমা ওনাদের খারাপ লাগা বুঝতে পেরে একটু ম্যানেজ করে নিয়ে বললেন,

–এই দ্যাখো কাণ্ড।কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি।কখন ভাত শেষ হয়ে গেছে রূপার।বৌমা ভাতটা নিয়ে এসো।তোমার রূপা মাসিকে দুটো ভাত দাও।আর তোমার শোভা মাসিকে মাছের মাথাটা দাও।ও আবার মাথা খেতে ভালোবাসে।

আমি তো শুনে হাসছি মনে মনে।অত গুলো কথা বলেও আবার ঠিক ম্যানেজ করে নিলেন।তার মধ্যেও যেন কথাতেই ঘা দিলেন।খাওয়া দাওয়া সারা হয়ে যেতেই আমার শাশুড়িমা ওই দুই আত্মীয়া মানে শাশুড়ির পিসতুতো দুই বোনকে বললেন,

–তোরা তাহলে বিকেলে কখন বেরোবি?জানো বৌমা তোমার দুই মাসি কিছুতেই থাকতে চায় না।যখনই আসে একবেলা কাটিয়ে চলে যায়।

জানিনা ওই দুই আত্মীয়ার থাকার ইচ্ছে ছিল কিনা।ওনারা বাড়ি চলে যেতেই আমার শাশুড়িমা বললেন,

–এই সব লোকেদের আমি একদম পছন্দ করি না।আমার নিজের পিসতুতো বোন তো কী হয়েছে?একবেলার জন্য আসবে সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যাবে।ওটাই ওদের স্বভাব।দেখছে আমি ভালো আছি,কিছু তো একটা করতে হবে?শাশুড়ি বৌমার ঝামেলা বাঁধিয়ে দিই আর কি!

সেই প্রথম শাশুড়িকে একটু হলেও চিনতে পারলাম।বিয়ের পর আমি শাড়িই পরতাম।গ্রামের দিকে তখন চুরিদার পরার অতোটা রেওয়াজ নেই।একদিন শাশুড়ি বললেন, বাড়িতে চুরিদার নাইটি পরতে পারো।আমি শাশুড়ির কথা শুনেই নাইটি পরতাম।একদিন পাশের বাড়ির একজন কাকিমা আমার শাশুড়িকে বললেন,

-তোমার বৌমা বাড়িতে নাইটি পরে তা তুমি কিছু বল না?কথা শোনে না মনে হয়, তাই না?এখনকার মেয়ে,ও তুমি বললেও শুনবে না।

দেখলাম আমার শাশুড়ি কিছুই সেদিন বলল না।পরের দিন দেখি দুটো নাইটি কিনে নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে বলল,

–কোনটা নেবে?

আমি একটা পছন্দ করে নিয়ে তারপর জিজ্ঞেস করলাম,

–আর একটা কার জন্য?

–ওটা আমিই পরব।

পরের দিন ওই কাকিমাকে দেখিয়ে আমার শাশুড়ি বললেন,

–ভাবছি এবার থেকে নাইটিই পরব।শাড়ির থেকে দেখছি নাইটিই ভালো।

ওই কাকিমা তখন একটু মুখ বাঁকিয়ে বলল,

–আমার শাড়িই ভালো লাগে।

পরে আমি শাশুড়িমাকে জিজ্ঞেস করে ছিলাম,

–আপনি হঠাৎ করে নাইটি পরলেন?

–সব কথার মুখে জবাব দিতে নেই।কাজে দিতে হয়।কী পরব,কী খাব সেটা বাইরের লোক ঠিক করে দেবে?এদের পাত্তা দিলেই সংসারে অশান্তি।আর যদি না দাও তাহলে ওদের মনে অশান্তি।এবার বুঝতে হবে কারা শান্তিতে থাকবে?আমরা না ওরা?যদি নিজেরা ভালো থাকতে চাই এই রকম দু একটা জবাব দিতে হবে।স্ট্রেট কথা বলতে হবে।বুঝবে বনে বাঘ আছে।তাই বনে না যাওয়াই ভালো।

শাশুড়ি সম্পর্কে ভুল ধারণাটা পুরোপুরি চলে গেল।আমিও শাশুড়ির নীতি শিখে গেলাম।আত্মীয়ই হোক,আর অনাত্মীয়ই হোক,উচিত কথাই বলতে হবে।তাতে নিজেদের মঙ্গল।আমার শাশুড়ি বলেন,স্পষ্ট কথা বললে বন্ধু কম হয়, আর শত্রু বেশি হয়।দুটো বন্ধু কমে কমুক,কিন্তু উচিৎ কথাই বলব।স্পষ্ট কথার কষ্ট কম।

নিজেরা ভালো থাকার জন্য আমার শাশুড়ি কারো অন্যায় কথা বার্তাকে প্রশ্রয় দেয় না।পরনিন্দা পরচর্চা একদমই পছন্দ করে না।পাড়ার গোল‌ টেবিল বৈঠকে শাশুড়িমাকে কখনো বসতে দেখিনি।কিন্তু বিপদে ছুটে যেতে দেখেছি।তাই ভালো থাকতে গেলে জীবনে অনেক বন্ধুর প্রয়োজন নেই।কম মানুষই থাকুক।তাতে ভালো থাকা যায়।

তবে আমার শাশুড়ির সাথে কি কখনো খিটিমিটি হয় নি?হয়েছে।রাগও করেছি,ঝগড়াও করেছি।শাশুড়িমা এটাই শিখিয়েছে,এমন কোনো বাড়ি নেই,যেখানে ঝগড়া অশান্তি হয় না।ঘটি বাটি পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি লাগে।বিয়ের পর যেদিন প্রথম শাশুড়ির সাথে রাগারাগি হল,আমি সেদিন রাগে খাইনি।আমাকে বকাবকি করে কয়েকটা কথা শুনিয়েছিল।তাই রাগে আমি আমার ঘরে শুয়েছিলাম।সেদিন শাশুড়িমা আমার ঘরে এসে বললেন,

–বৌমা উঠে বস।একটা কথা তোমাকে আজ বলব।

নিজে থেকেই যখন আমার ঘরে এসেছেন তাই উঠে বসে রাগ দেখিয়ে বললাম,

–বলুন।

শাশুড়ি মা আমার হাতটা ধরে বললেন,

–এই যে তোমার হাতের আঙুলের নখ গুলো যখন বেড়ে যায় তখন নখ গুলোই কেটে বাদ দাও।আঙুল কিন্তু কেটে বাদ দাও না।নখ কিন্তু আঙুলেই বাড়ে।সংসারে থাকতে গেলে একটু আধটু তো ঝামেলা হবেই।তাই ঝামেলা টুকু মনে না রেখে সেটা বাদ দিয়ে দিলে দেখবে সংসারের সব ভালোটুকুই পড়ে আছে।রাগ না করে খাবে চলো।রাগ করতে হলে খেয়ে দেয়ে রাগ করো।

শাশুড়িমার ওই কথাটাই আমার সংসার জীবনের মূল মন্ত্র।কথাটা এত ভালো লেগে ছিল সেই থেকেই এখনো মনে গাঁথা আছে।তবে শাশুড়িমার ওই কথাটা ভীষণ দামী।”রাগ করতে হলে খেয়ে রাগ করো।” সত্যিই তাই।যখন রাগ হবে না খেয়ে থাকলে দেখবেন আরো রাগ বাড়ছে।একবার খেয়ে নেবেন,সব রাগ চলে যাবে।

বিয়ের পর আমরা মেয়েরা শুধু শ্বশুর বাড়িই যাই না,শাশুড়ির হেঁশেলে গিয়েও উঠি।শাশুড়ি মানে খারাপ নয়,তাই কারো সম্পর্কে খারাপ চিন্তা না করে ভালো চিন্তা করাটাই ভালো‌।তাতে ভবিষ্যতে ভালোই হয়।আমার বিয়ে হয়েছে পনেরো বছর।বিয়ের পর থেকে শাশুড়িমা টানা দশ বছর আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন।আমিই শাশুড়িকে বলেছি,আপনার হেঁশেল থেকে এবার অবসর নেওয়ার পালা।এখন আমি রান্না করব,আপনি খাবেন।তারপর থেকে পাঁচ বছর হলো আমিই শাশুড়ির হেঁশেল সামলাচ্ছি।

শাশুড়ির হেঁশেল

লেখা ও ছবি: #সংগৃহীত
MD Layek Ahmed