today visitors: 5073432

মাদক কি ও প্রতিকার;ধর্মীয় দৃষ্টিকোন।

এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব

ইসলাম সকল প্রকার মাদক তথা নেশাদার দ্রব্য হারাম ঘোষণা করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَ كُلُّ خَمْرٍ حَرَامٌ ‘প্রত্যেক নেশাদার দ্রব্যই মদ আর যাবতীয় মদই হারাম’।(১) অথচ এই মাদকের ভয়ংকর থাবায় আজ বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানব সভ্যতা। এর সর্বনাশা মরণ ছোবলে জাতি আজ অকালে ধ্বংস হয়ে যচ্ছে। ভেঙ্গে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বৃদ্ধি পাচ্ছে চোরাচালানসহ মানবতা বিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ। মাদকাসক্তির কারণে সকল জনপদেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বেড়ে গিয়ে মানুষের জান-মাল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজের অধিকাংশ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, لاَتَشْرَبِ الْخَمْرَ، فَإِنَّهُ مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ. ‘মদ পান করো না। কেননা তা সকল অপকর্মের চাবিকাঠি’।(২) অন্য হাদীসে এসেছে, اِجْتَنِبُوا الْخَمْرَ فَإِنَّهَا أُمُّ الْخَبَائِثِ. ‘তোমরা মদ থেকে বেঁচে থাক। কেননা তা অশ্লীল কাজের মূল’।(৩) আলোচ্য প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে মাদকতা ও এর প্রতিকারের উপায় আলোচনা করা হলো –
আভিধানিকভাবে : মাদকদ্রব্যের আরবী প্রতিশব্দ ‘খামর’ (خمر)। এর অর্থ- সমাচ্ছন্ন করা, ঢেকে দেয়া। এই সকল অর্থের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণেই মদ ও শরাবকে ‘খামর’ বলা হয়।
Cambridge Dictionary-তে বলা হয়েছে, An alcoholic drink which is usually made from grapes but can also be made from other fruits or flowers. It is made by FERMENTING, the fruit with water and sugar.

‘মদ হলো নেশাকর পানীয় যা সাধারণত আঙ্গুর থেকে তৈরী হয়। তবে অন্যান্য ফল ও ফুল থেকেও তৈরী হতে পারে। এটা উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য চিনি ও পানির মাধ্যমে ফল দ্বারা তৈরী হয়’।

পারিভাষিকতায় : ‘যে সকল বস্ত্ত সেবনে মাদকতা সৃষ্টি হয় এবং বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে অথবা বোধশক্তির উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে তাকে মাদকদ্রব্য বলে। কবি বলেন, شَرِبْتُ الْخَمْرَ حَتَّى ضَلَّ عَقْلِىْ + كَذَاكَ الْخَمْرُ تَفْعَلُ بِالْعُقُوْلِ. ‘মদ পান করে আমার বিবেক হারিয়ে গেছে। মদ এভাবেই বুদ্ধিকে নিয়ে খেল-তামাশা করে’। সাধারণত নেশা জাতীয় দ্রব্যসামগ্রী গ্রহণ করা বা পান করাই মাদকাসক্তি।
এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণী : وَ الْخَمْرُ مَا خَامَرَ الْعَقْلَ ‘মদ বা মাদকদ্রব্য তাই, যা জ্ঞান-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে’।(৪)
মাদক নিষিদ্ধকরণের ক্রমধারা : ইসলাম শুরুতেই মদ হারাম ঘোষণা করেনি; বরং এটি নিষিদ্ধকরণে শরী‘আত এমন পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল যে, আজীবনের অভ্যাস ত্যাগ করা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত সহজ বলে মনে হয়েছিল। এজন্য ইসলাম একান্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথমে শরাবের মন্দ দিকগুলো মানব মনে বদ্ধমূল করেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যখন আসমানী বিধান নাযিল হচ্ছিল তখন মদ সমগ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেজন্য এ পথ অবলম্বন করতে হয়েছে। কেননা তখন যদি হঠাৎ মাদক করে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হত, তাহলে তা পালন করা তখনকার লোকদের পক্ষে বড়ই কঠিন হয়ে পড়ত। অনেকে হয়ত তা গ্রাহ্যই করত না।
কুরআন মাজীদে প্রথমতঃ মদের অপকারিতা ও পাপ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيْهِمَا إِثْمٌ كَبِيْرٌ وَّمَنَافِعُ لِِّلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন! এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়’ (বাক্বারাহ ২১৯)। এরপর নামাজের সময় মদ পান হারাম করে আল্লাহ ঘোষণা করেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ لاَ تَقْرَبُوا الصَّلاَةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّىَ تَعْلَمُواْ مَا تَقُوْلُوْنَ. ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারে-কাছেও যেও না। যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছো (নিসা ৪৩)। এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট হচ্ছে- একজন ব্যক্তি মদ্যপ অবস্থায় নামাজ আদায় করার সময় পড়ে قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ- أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ- ‘হে কাফেররা! তোমরা যার ইবাদত কর, আমি তার ইবাদত করি’। এভাবে গোটা সূরা সে ‘না’ সূচক অব্যয় لا বাদ দিয়ে পড়ে’।(৫) অতঃপর মদ চিরতরে হারাম ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنْصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ- إِنَّمَا يُرِيْدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُّوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِيْ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُّنْتَهُوْنَ-

‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের কার্য বৈ কিছু নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা এখন কি নিবৃত্ত হবে?’ (মায়েদাহ ৯০-৯১)।
শরীয়তের নির্দেশ সমূহের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, ইসলামী শরীয়ত কোন বিষয়ে কোন হুকুম প্রদান করতে গিয়ে মানবীয় আবেগ-অনুভূতি সমূহের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছে, যাতে মানুষ সেগুলোর অনুসরণ করতে গিয়ে বিশেষ কষ্টের সম্মুখীন না হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إلاَّ وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)।
রাসূল (সাঃ)-এর প্রেরিত এক ব্যক্তি যখন মদীনার অলিতে-গলীতে প্রচার করতে লাগল যে, মদ্যপান হারাম করা হয়েছে, তখন যার হাতে শরাবের যে পাত্র ছিল, তা তারা সেখানেই ফেলে দিয়েছিল। যার কাছে মদের কলস বা মটকা ছিল, তা ঘর থেকে তৎক্ষণাৎ বের করে ভেঙ্গে ফেলেছিল।(৬)
খাদেমে রসূল (সা:) হযরত
আনাস (রাঃ) এক মজলিসে মদ পরিবেশনের কাজ সম্পাদন করছিলেন। আবু তালহা, আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ, উবাই ইবনে কা‘ব, সুহাইল (রাঃ) প্রমুখ নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণ সে মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। প্রচারকের ঘোষণা কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, এবার সমস্ত শরাব ফেলে দাও। এর পেয়ালা, মটকা, হাড়ি ভেঙ্গে ফেল।(৭)

মদপানকারী জান্নাতে প্রবেশ
করবে না : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, لاَيَدْخُلُ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ خَمْرٍ. ‘সর্বদা মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।(৮)

মদ্যপের ৪০ দিনের নামাজ কবুল হয় না :আব্দুল্লাহ ইবনু আ’মর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তার ৪০ দিন নামাজ কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে যাবে। যদি তাওবাহ করে তাহলে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। আবার নেশাদার দ্রব্য পান করলে আল্লাহ তার ৪০ দিন নামাজ কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে যাবে। আর যদি তাওবাহ করে তবে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। আবার যদি নেশাদার দ্রব্য পান করে আল্লাহ তার ৪০ দিন নামাজ কবুল করবেন না। এ অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে যাবে। তাওবাহ করলে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করবেন। লোকটি যদি চতুর্থবার মদ পান করে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন ‘রাদাগাতুল খাবাল’ পান করাবেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! ‘রাদাগাতে খাবাল’ কী? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘আগুনের তাপে জাহান্নামীদের শরীর হ’তে গলে পড়া রক্তপূজ মিশ্রিত গরম তরল পদার্থ’।(৯)

মদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অভিসম্পাত : মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর লোকের প্রতি রাসূল (সাঃ) অভিশাপ করেছেন। (১) যে লোক মদের নির্যাস বের করে (২) প্রস্তুতকারক (৩) মদপানকারী (৪) যে পান করায় (৫) মদের আমদানীকারক (৬) যার জন্য আমদানী করা হয় (৭) বিক্রেতা (৮) ক্রেতা (৯) সরবরাহকারী এবং (১০) এর লভ্যাংশ ভোগকারী’।(১০)

ক্বিয়ামতের পূর্বে মদের ব্যাপকতা : ক্বিয়ামতের পূর্বে মাদকতা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে মদ পানকারীরা তা পান করাকে অপরাধ মনে করবে না। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে ,

عَنْ أَنَسٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَكْثُرَ الْجَهْلُ وَيَكْثُرَ الزِّنَا وَيَكْثُرَ شُرْبُ الْخَمْرِ وَيَقِلَّ الرِّجَالُ وَتَكْثُرَ النِّسَاءُ حَتَّى يَكُوْنَ لِخَمْسِيْنَ امْرَأَةً القَيِّمُ الْوَاحِدُ.

আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘কিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে, ইলম উঠে যাবে, মূর্খতা, ব্যভিচার ও মদ্যপান বেড়ে যাবে। পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি পঞ্চাশ জন মহিলার পরিচালক হবে একজন পুরুষ’।(১১)শুধু তাই নয়; শেষ যামানায় মানুষ মদকে বিভিন্ন নামের ছদ্মাবরণে পান করবে বলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।(১২)

মাদকের কুফল : যেকোন প্রকার মাদকদ্রব্য যা নেশা সৃষ্টি করে, সুস্থ মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটায় এবং জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি লোপ করে দেয়, তা হারাম বা নিষিদ্ধ, চাই তা প্রাকৃতিক হোক যেমন- মদ, তাড়ি, আফিম, গাঁজা, চরস, হাশিশ, মারিজুয়ান ইত্যাদি অথবা রাসায়নিক হোক যেমন- হেরোইন, মরফিন, কোকেন, প্যাথেড্রিন ইত্যাদি। মাদক মানুষের শরীরে বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করে থাকে। নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি বিনষ্ট হয়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়, শারীরিক ক্ষমতা লোপ পায়। আবার এমন অনেক মাদকদ্রব্য আছে, যা সম্পূর্ণরূপে কিডনী বিনষ্ট করে দেয়। মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস করে ফেলে, যেটা কোন চিকিৎসার মাধ্যমেই সারানো সম্ভব নয়। মাদক সেবনের ফলে লিভার সিরোসিস রোগের সৃষ্টি হয়, যার চিকিৎসা দুরূহ।

প্রতিকারের উপায়:
১. ইচ্ছাশক্তি : মাদক বর্জনের জন্য মাদকগ্রহণকারীর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রামাযান মাস মুসলমানদের মাদক বর্জনের উপযুক্ত সময়। সারাদিন মাদক ছাড়া থাকতে পারলে রাতটুকুও থাকা সম্ভব। এভাবে এক মাস অভ্যাস করলে মাদক ত্যাগ করা সহজ হবে।
২. ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা : ইসলামের শিক্ষা ও বিধি-বিধান পুরোপুরি মেনে চললে মাদক বর্জন করা সহজ হবে।
৩. সামাজিক প্রতিরোধ : মাদক নিবারণের জন্য সমাজ ও স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। মাদক গ্রহণ করাকে ঘৃণার চোখে দেখা উচিত। সমাজপতিগণ নিজেরা মাদকমুক্ত থেকে এবং তাদের প্রভাব খাটিয়ে মাদক প্রতিরোধ করতে পারেন।
৪. মাদকমুক্ত এলাকা গড়ে তোলা : স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অফিস, আদালত প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মাদক বর্জন করা প্রয়োজন।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি : শিশুকাল থেকেই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে। যাতে ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ পালনে তারা আগ্রহী হয়। সাথে সাথে মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা তৈরী করতে হবে। যাতে আল্লাহ পাকের প্রতিটি কথা পালন করতে অভ্যস্থ হয়ে উঠে। মাদক গ্রহণের ক্ষতিকর বিষয় সম্বন্ধে শারীরিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিকগুলো তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকের ক্ষতি ও অপকারিতা সম্বন্ধে অবহিত হলে এই বদাভ্যাস ত্যাগ করা ও এর প্রতি ঘৃণা জন্মানো সহজ হবে।
৬. চিকিৎসকদের উদ্যোগ : মাদক প্রতিরোধে চিকিৎসকগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন এবং জনগণকে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে অবগত করে তাদের এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
৭. আলেম ওলামা ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা : মসজিদের ইমামসহ সমাজের আলেমগণ ইসলামের দৃষ্টিতে মাদকের অপকারিতা সম্বন্ধে জনগণকে অবহিত করতে পারেন এবং মদ্যপায়ীদেরকে ছালাতের দিকে আহবান করে ন্যায়ের পথ দেখাতে হবে। যাতে করে তারা অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ان الصلوة تنهى عن الفحشاء و المنكر- ‘নামাজ অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’ (আনকাবূত ৪৫)। আর ছালাত আদায়ের প্রতি যদি কেউ বিনয়ী হয় তাহ’লে তাকে নেশাদ্রব্য অবশ্যই ছাড়তে হবে।
শেষ কথা : পরিশেষে প্রতীয়মান যে, বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হওয়ার কারণে মাদকের মারাত্মক ক্ষতি সর্বজন স্বীকৃত। ইউরোপীয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতা মদ, নারী ও সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক বিশ্বে এ সভ্যতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর পূর্বেই সমাজকে সুসভ্য করার জন্য মাদক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
ইসলাম মানবতার রক্ষাকবচ। ইসলাম মানুষকে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে। ইসলাম মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে হেফাযতের জন্য মাদক বিরোধী আইন রচনা করেছে। একটি সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের জন্য সুস্থ মস্তিস্ক একান্তভাবেই কাম্য। মাদক মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা গোটা মানব সমাজের অকল্যাণ ও অমঙ্গল সাধিত হয়। আজ মাদকাসক্তি বিশ্ব মানবতার জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি অসংখ্য পাপকার্য, অপরাধ ও অসামাজিক কর্মের মূল। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো লক্ষ্য করে এর প্রতিকারের জন্য বর্তমান বিশ্বে বহু দেশ ও জাতী এগিয়ে আসছে। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় মাদকতা থেকে বিরত থেকে মাদকমুক্ত আদর্শ সমাজ গড়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
প্রতিষ্ঠাতা:কুমিল্লা জিলা মাদরাসা।
খতিব,প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী ও টিভি উপস্থাপক।

তথ্য সূত্র :

(১). মুসলিম, মিশকাত -৩৬৩৮।

(২).ইবনু মাজাহ -৩৩৭১।

(৩).নাসাঈ -৫৬৬৭।

(৩). বুখারী; মিশকাত -৩৬৩৫ ‘হুদূদ’ অধ্যায়।

(৫). ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩৪৯।

(৬). মুসলিম -৩৬৬২।

(৭).বুখারী -৬৭১২।

(৮)ইবনু মাজাহ -৩৩৭৬।

(৯). ইবনু মাজাহ -২৭৩৮।

(১০). তিরমিযী, মিশকাত -২৭৭।

(১১). মুত্ত্বাফাকুন আ’লাইহ; মিশকাত -৫৪৩৭, ‘ফিতান’ অধ্যায়, ‘ক্বিয়ামতের আলামত’ অনুচ্ছেদ।

(১২). ইবনু মাজাহ, – ৩৩৮৪।