এস চাঙমা সত্যজিৎ
স্টাফ রিপোর্টারঃ
খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়িতে জনতার আদালতের রায়ে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, ভিডিপির প্লাটুন কমাণ্ডার সালেহ আহমেদ ও নুরুল হককে প্রতীকী ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুন ২০২৪) বিকাল ৩ টায় লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মছড়ি ইউনিয়নের হুদুকছড়ি মাঠে ‘কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৮ বছর’ উপলক্ষে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও জনতার আদালতের মাধ্যমে এই প্রতীকী ফাঁসি দেওয়া হয়। জনতার আদালত পরিচালনা করেন সরল চাকমা। এতে এলাকার ছাত্র-ছাত্র, যুবক-যুবতী ও গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গসহ চার শতাধিক লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
সমাবেশে জনতার আদালতের পক্ষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ে সরল চাকমা ১৯৯৬ সালের ১১ ও ১২ জুনের মধ্যবর্তী রাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তৎকালীন কজইছড়ি ক্যাম্পের অধিনায়ক লে. ফেরদৌস, ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার সালেহ আহমেদ ও সদস্য নুরুল হকের নেতৃত্বে অপহরণের ঘটনা এবং এ ঘটনায় বাদী কালিন্দি কুমার চাকমার দায়েরকৃত মামলার তদন্ত রিপোর্ট, তৎসময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষন, দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তদন্তের নামে প্রহসন ও সর্বশেষ আদালত কর্তৃক মামলা খারিজ করে দিয়ে অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
এ সময় তিনি গত ২৩ এপ্রিল ২০২৩ রাঙামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজেস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা-এর পুলিশের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাদীর নারাজী আবেদন নামঞ্জুর করে মামলাটি অবসানের আদেশকে বিচারিক গর্ভপাত ছাড়া আর অন্য কিছু আখ্যা দেয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন।
উক্ত অপহরণ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ শেষে সরল চাকমা জনতার আদালতের পক্ষে চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, সালেহ আহমেদ ও নুরুল হককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় ও পুলিশের তদন্ত রিপোর্টগুলোতে স্বীকার করা হয়েছে যে, কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন। কিন্তু কারা অপহরণ করেছে তারা তা জানেন না। কেন জানেন না? কারণ তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলেননি, তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেননি। কিন্তু কালিন্দী কুমার চাকমাসহ প্রত্যক্ষদর্শীরা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তারা অপহরণকারী দলের তিন জনকে চিনতে পেরেছেন: এরা হলো তৎকালীন কজইছড়ি ক্যাম্প কমান্ডার লে. ফেরদৌস, ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার সালেহ আহমেদ সদস্য নুরুল হক ।
অতএব, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, তৎকালীন বাঘাইছড়ি টিএনও জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য, ঘটনার পর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সরেজমিন তদন্ত রিপোর্ট, পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক প্রিসিলা রাজ ও মোর্শেদ আলী খানসহ বিভিন্ন জনের রিপোর্ট বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে লক্ষীছড়ি জনতার আদালত এই মর্মে ঘোষণা করছে যে,
ক) লে. ফেরদৌস, ভিডিপির প্লাটুন কমান্ডার সালেহ আহমদ ও সদস্য নুরুল হক যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে জোরপূর্বক অপহরণ করেছে তা সুস্পষ্টভাবে ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
খ) প্রতিশোধপরায়ণতা বশতঃ তারা এই অপহরণ ঘটনা সংঘটিত করেছে। ঘটনা পরম্পরায় দেখা যায়, উক্ত অপহরণ ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পের একটি দল নিকটবর্তী একটি পাহাড়ি গ্রামের কয়েকটি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার পর লে. ফেরদৌস নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে গেলে কল্পনা চাকমা তার কাছে উক্ত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন, অধিকার, তাদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদি বিষয়েও তাদের মধ্যে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ড হয়। লে. ফেরদৌস কল্পনা চাকমার যুক্তির কাছে হেরে যান। এতে লে. ফেরদৌস প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেন এবং ১৯৯৬ সালের ১১ ও ১২ জুনের মধ্যবর্তী রাতে তাকে অপহরণ করেন।
জনতার আদালতের পক্ষে সরল চাকমা অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা দিয়ে বলেন, অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় লক্ষীছড়ি জনতার প্রতীকী আদালত কল্পনা চাকমাকে অপহরণের জন্য লে. ফেরদৌস, সালেহ আহমদ ও নুরুল হককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করছে। তাদের তিন জনের কুশপুত্তলিকা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এই মৃত্যুদণ্ড আজই কার্যকর করা হবে।
এছাড়া ন্যায়বিচার প্রদানে ব্যর্থ হওয়া, আসামীদের রক্ষার চেষ্টা করা ও দায়মুক্তি দেয়ার জন্য ২৪ পদাতিক ডিভিশনসহ রাষ্ট্রকে কড়া সতর্ক করা হলো। এ প্রসঙ্গে সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জনতাই হলো দেশের আসল ক্ষমতার মালিক। জনতার আদালতই হলো সর্বোচ্চ আদালত। তাই সরকারকে এ রায় অনুসরণের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে।
জনতার আদালতের ঘোষণা মোতাবেক উপস্থিত জনতা কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, সালেহ আহমেদ ও নুরুল হকের কুশপুত্তলিকা প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।
আদালতের কার্যক্রম শেষে “কল্পনা চাকমার সন্ধান চাই, অপরাধীদের সাজা দাও, দায়মুক্তির রায় মানি না, মানব না” শ্লোগানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের মন্ডিরা তাঁতি’র সভাপতিত্বে ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন লক্ষীছড়ি উপজেলা সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফের লক্ষীছড়ি ইউনিটের সংগঠক আপ্রুশি মারমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের লক্ষীছড়ি উপজেলা সভাপতি সচিব চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন লক্ষীছড়ি উপজেলা অর্থ সম্পাদক মনি চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ লক্ষীছড়ি উপজেলা সভাপতি জয় চাকমা।
এস চাঙমা সত্যজিৎ
স্টফ রিপোর্টার প্রথম বুলেটিন।