- ঘুষ দাবি করে বদলি হওয়া কৃষি কর্মকর্তাই পেলেন রাজশাহীর চার জেলার দায়িত্ব
রহিদুল ইসলাম, রাজশাহীঃ
দুইবছরেরও কম সময় আগে সার ডিলারদের কাছে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে বদলি করা হয়েছিল নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তৎকালীন উপপরিচালক মাহমুদুল ফারুককে। এক বছর ৯ মাস পর অন্তত ২৫ জন জ্যেষ্ঠ পদের কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে বহুল বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে কৃষি বিভাগের রাজশাহীর চার জেলার প্রধান হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এ নিয়ে কৃষি বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ-১ শাখার উপসচিব কামরুল হাসান গত ২৯ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে ঈশ^রদীর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসানকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পদায়ন করেন। অথচ মাহমুদুল ফারুক কৃষি বিভাগের পঞ্চম গ্রেডের উপপরিচালক পদের কর্মকর্তা। তৃতীয় গ্রেডের পদ হলো অতিরিক্ত পরিচালক। তৃতীয় গ্রেডের অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা অঞ্চল ফাঁকা না থাকার কারণে অতিরিক্ত পরিচালক পদে বসতে পারছেন না। সেখানে রাজশাহীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিম্নপদের বিতর্কিত কর্মকর্তাকে বসানো হয়েছে।
ডিডির ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাই জুনিয়র কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের অধীনে রাজশাহী ছাড়াও রয়েছে নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই চার জেলার কৃষি বিভাগের উপপরিচালকেরা (ডিডি) অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিডি মোজদার হোসেন ১৩তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা। আর তাঁর ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা নতুন ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল ফারুক ১৫ বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা। অর্থাৎ, উপপরিচালকের চেয়ে অতিরিক্ত পরিচালকই জুনিয়র। যদিও পদমর্যাদায় দুজনেই উপপরিচালক। বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য জানতে মোজদার হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি।
তৃতীয় গ্রেডের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চাকরিজীবনের শেষে তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তাদের চাওয়া থাকে অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে অবসরে যাওয়া। অঞ্চল ফাঁকা না থাকার কারণে অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা এ পদে আসতে পারছেন না। অথচ এই পদে পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তাকে বসানো দুঃখজনক। শুনেছি, মন্ত্রণালয়ের এক বড় কর্মকর্তার স্বামীকে অবৈধ সুবিধা দিয়ে মাহমুদুল ফারুক এই পদে এসেছেন। মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। মাহমুদুল ফারুকের বাড়িও একই জেলায়।’
ঘুষ চেয়ে বদলি হন ফারুক
মাহমুদুল ফারুক ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ২৩ মে পর্যন্ত নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিডি ছিলেন। সে সময় তিনি নাটোরের সার ডিলারদের কাছে ঘুষ দাবি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। সার বিক্রির লভ্যাংশ থেকে পার্সেন্টেজ দাবি করার কারণে ডিলাররা সার বিক্রিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নাটোর জেলা শাখার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয় ডিবি মাহমুদুল ফারুকের বিরুদ্ধে। জেলা প্রশাসন এ অভিযোগের তদন্ত করে।
ওই লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছিল, ডিডি মাহমুদুল ফারুক সিংড়া উপজেলার সার ডিলার এ এফ এম মাহফুজুর রহমানের কাছে ঘুষ দাবি করেছেন। ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি সভা শেষে মাহমুদুল ফারুক ডিলার মাহফুজুর রহমানকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সভা শেষে মাহফুজুর, গুরুদাসপুর উপজেলার সার ডিলার আব্দুল মজিদ ও বাগাতিপাড়ার ডিলার সুভাশীষ গারোদিয়া ডিডির সঙ্গে দেখা করতে যান।
এ সময় ডিডি তাদের কাছে সার বিক্রির পার্সেন্টেজ দাবি করেন। বিষয়টি গোপন রাখার জন্যও সর্তক করে দেন। এ সময় ডিলাররা তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনার কথা বলে চলে আসেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ডিডি নানা অজুহাতে জেলার সার ডিলারদের হুয়রানি করা শুরু করেন। ফলে কৃষকদের কাছে সময়মতো তারা সার পৌঁছাতে পারছিলেন না।
ওই অভিযোগের তদন্ত শেষে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ডিডি মাহমুদুল ফারুককে বদলির জন্য অধিদপ্তরে সুপারিশ করেন। পরে তাকে ঈশ^রদীর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ হিসেবে বদলি করা হয়। নাটোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ এখন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক। তিনি জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ঢাকায় থাকার কারণে তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার সমিতির নাটোর জেলা শাখার সভাপতি আবদুস সালাম জানান, ঘুষ দিতে না চাওয়ার কারণে তৎকালীন ডিডি ফারুক কৃষি বিভাগ থেকে নানা শর্ত উল্লেখ করে চিঠি পাঠান। পরে তিনি সব ডিলারের কাছে আলাদাভাবে ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ না দিলে প্রকাশ্যে হয়রানি করারও ঘোষণা দেন। এ নিয়ে অভিযোগ করলে কিছুদিন পর তার বদলি হয়ে যায়।
এই কর্মকর্তাকে রাজশাহীর চার জেলার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে আবদুস সালাম বলেন, ‘এটাই হওয়ার কথা। আমি নির্বাচন করতে গেলে মনোনয়ন পেতে টাকা লাগে। তেমনি এ ধরনের পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে টাকার খেলা চলে। ঘুষ খাওয়া কর্মকর্তার টাকা বেশি। তিনিই তো ভাল পদ পাবেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাহমুদুল ফারুকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে তিনি শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। ২০১১ সালের দিকে তার বিরুদ্ধে কৃষকদের কৃষিকার্ড দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। পরে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে বরগুনার পাথরঘাটা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়।
পরবর্তীতে তিনি নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক হয়ে আসেন। পরে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হন। মাহমুদুল ফারুক রাজশাহী নগরীতে জমি কিনে সাততলা একটি ভবন করেছেন। ঘুষের টাকায় এ বাড়িটি নির্মিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বুধবার দুপুরে যোগাযোগ করা হলে মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘আমাকে আমার পদে থেকেই অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তবে কাগজপত্র সব রেডি হচ্ছে। পদোন্নতিও হয়ে যাবে।’ তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, না। অভিযোগ সত্য না। আমি একটা মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলব।’
ভাল হয়ে গেছেন ফারুক
ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠলেও মাহমুদুল ফারুক এখন ভাল হয়ে গেছেন বলে মনে করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বুধবার দুপুরে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘চাকরিজীবনে একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতেই পারে। মাহমুদুল ফারুকের ঘুষ চাওয়ার ওই অভিযোগের তদন্ত হয়েছিল। অভিযোগ সেভাবে প্রমাণিত হয়নি। তারপরেও তিনি যেহেতু বিতর্কিত হয়েছিলেন, তাই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। বদলি হওয়ার পরে তিনি কাজ করেছেন। কাউকে তো বসিয়ে রাখা যাবে না। ছোটখাট ভুল-ত্রুটি থাকলেও এই দুইবছরে তিনি নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। সে কারণে তাঁকে রাজশাহীর চার জেলার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
তৃতীয় গ্রেডের অন্তত ২৫ কর্মকর্তাকে রেখে পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা ফারুককে অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তারা তৃতীয় গ্রেডের পদেই দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা কেউ পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তার কাজ করছেন না। তাই পঞ্চম গ্রেডের কাউকে তৃতীয় গ্রেডের দায়িত্ব দিলে কারও ক্ষোভ থাকার কথা নয়।’