এস চাঙমা সত্যজিৎ
স্টাফ রিপোর্টারঃ
বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবসে খাগড়াছড়িতে শোভাযাত্রা, প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য ও নারী সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত দুই নারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি ১০ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।
আজ ১৫ অক্টোবর ২০২৪, মঙ্গলবার সকালে খাগড়াছড়ি সদরে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কর্মসূচি শুরুর পূর্বে বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস বিষয়ে খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় মাইকিং ও বিভিন্ন প্রতিবাদী গান বাজানো হয়।
বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস উপলক্ষে দুই নারী সংগঠন স্বনির্ভর হতে রেড স্কোয়ারের দিকে শোভাযাত্রা শুরু করে।
“আত্মরক্ষার্থে নারীরা বেরিয়ে এসো, রুখে দাঁড়াও, বিনা দোষে সন্তান খুন-গুরুতর জখম, কন্যা ধর্ষণের শিকার, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ-লুটপাট নিরাপত্তাহীনতা পরিবেশে নারীরা নিশ্চুপ থাকতে পারে না’’ এই ব্যানার স্লোগানে বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন প্রদর্শন সহকারে সকাল ১১টার সময় স্বনির্ভর বাজার থেকে শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভযাত্রাটি জেলা পরিষদ হয়ে নারাঙহিয়া রেড স্কয়ারে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
সমাবেশে গত ১৯ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদ জুনান চাকমা মা রুপসা চাকমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে তুমুল করতালির মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। এতে শহীদ রুবেল ত্রিপুরার মা উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত হতে পারেননি।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা আহ্বায়ক এন্টি চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি কনিকা দেওয়ান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা ও শহীদ জুনান চাকমার মা রুপসা চাকমা।
সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, মাঠে-ঘাটে, ক্ষেত খামারের ভুমিকার পরেও আমাদের নারীদের রাজপথেও গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। পাহাড়ে যে হারে নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে সে তুলনায় দুষ্কৃতিকারীদের সাজা হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে একটি বিশেষ মহল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে বেশ তৎপর দেখা যাচ্ছে। খাগড়াছড়িতে মোটর সাইকেল চোরের ঘটনায় গণপিটুনি নিহত মামুনের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক ঘটনায় উগ্রবাদী একটি গোষ্টী তৎপর ছিল। যা মামুনের স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে সেনাবাহিনী পরিকল্পনা করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ব্রাশফায়ারের পরে গুলিবিদ্ধদের লাঠিপেটা ও পানি খেতে বাধ্য করেছে। যার ফলে গুলিবিদ্ধ রুবেল-জুনানরা আরো দুর্বল হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, দুষ্কৃতিকারী সোহেল রানার বিরুদ্ধে সমতলেও অনেক অভিযোগ ছিল। ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি সহ কুপ্রস্তাব দেয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠান থেকে অপসারনের জন্য খাগড়াছড়ির ছাত্রসমাজ ডিসি বরাবর স্মারকলিপি দিলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো প্রশাসন তার পক্ষাবলম্বন করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
শহীদ জুনান চাকমার মা রুপসা চাকমা বলেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে আমার ছেলেকে আর্মিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। ঘটনার পরে নাহিদ ইসলাম আমাদেরকে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে ডেকে ক্ষতিপুরন দিতে চেয়েছিল। আমরা তা গ্রহন করিনি। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চেয়েছি। যদি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার হতো তাহলে মনকে শান্তনা দিতে পারতাম। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাও দেখা করে ক্ষতিপুরণ হিসেবে ১ লক্ষ টাকা অফার করেছিলেন, আমরা তাও প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলাম, আপনারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন আমরা আপনাকে ৫ লক্ষ টাকা দেবো। ক্ষোভ এবং দুঃখের জায়গা থেকে মনের কথাগুলো আমরা বলেছি।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পরে সেনা প্রধান ঘোষনা করেছিলেন সেনাবাহিনীর গুলিতে আর কোন মায়ের বুক খালি হবে না। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার ২ দিন পরেই তারা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার ছেলে কোন বাঙালির ঘরবাড়িতে হামলা করতে যায়নি। কোন আইনে, কোন অধিকারে তারা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছে? আমার ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন শুরু করার আগে তারা কেন বিনা বিচারে হত্যা করলো? আমি তার সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রয়োজনে জাতিসংঘ থেকে তদন্ত কমিটি এসে নিরপেক্ষ তদন্ত করে আমার ছেলে হত্যাকারী সেনাসদস্যদের বিচার করতে হবে।
শহীদ জননী আরো বলেন, প্রয়োজনে এ নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবো, তবুও আমার মতো কোন মায়ের বুক খালি হতে দেব না। জাতির প্রয়োজনে, সমাজের প্রয়োজনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান বলেন, সারাদেশে পুলিশ কর্তৃক ঘোষিত সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে। আমি আশা করবো যাতে সাঁড়াশি অভিযানের নামে যাতে কোনো পাহাড়ি নারীকে নির্যাতনের শিকার কিংবা নিরীহ পাহাড়িকে হয়রানি হতে না হয়।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক বিষয় তুলে ধরে বলেন, নারীরা নিরাপত্তাহীন এবং প্রতিনিয়ত নানা হুমকির মধ্যে রয়েছে। সমতলে গ্রামাঞ্চলের নারীরা নানা নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। এমনকী ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও প্রায় ঘটে থাকে। সমতল অঞ্চলে সে সব ঘটনা আভ্যন্তরীণ সামাজিক দুর্বলতার কারণে হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতি ভিন্ন এবং জটিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী নারীর ওপর সংহিস যৌন আক্রমণ ঘটছে। ধর্ষণের মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রদানের ওপর সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে গোপন নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। ফলে এখানে ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো প্রতিবাদীকারীদের নানাভাবে হেনস্থা ও আক্রমণের শিকার হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টির একটি হচ্ছে, রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে আর অন্যটি অতি সাম্প্রতিক ১ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে সংঘটিত ধর্ষণ ঘটনা।
কণিকা দেওয়ান আরো বলেন, ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে সেনা টহল টিম কর্তৃক দুই মারমা সহদোরা ধর্ষণের শিকার হলে ভিক্টিমদের সহায়তা দিতে গিয়ে চাকমা রাণী য়েন য়েন রাঙ্গামাটি হাসপাতালে এক পদস্থ সেনা কর্মকর্তার হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। উক্ত ঘটনার কোন সুষ্ঠু বিচার হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
তিনি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে সংঘটিত ঘটনা তুলে ধরে বলেন, অতি সাম্প্রতিক ১ অক্টোবর ২০২৪ খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণীর এক কিশোরী শিক্ষকবেশী নরপশু কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। ঘটনার পর হাতে-নাতে ধৃত হলে উক্ত ধর্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের রোষের মুখে পড়ে এবং শিক্ষার্থীদের গণপিটুনীর কবল থেকে পালাতে গিয়ে রাস্তায় থ্রি হুইলার মহেন্দ্র-এর ধাক্কায় গুরুতরভাবে জখম হয়ে হাসপাতালে মারা যায়। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে জিগির তুলে সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়।
বাংলাদেশের অন্যত্র ধর্ষণ কিংবা পকেটমারদের গণপিটুনীতে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটলেও খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটির মতো পাহাড়ি বসতীতে তাণ্ডবলীলা চালানোর নজীর নেই। সমতলে কর্মস্থলে-যানবাহনে ধর্ষণের শিকার নারীকে মেরে ফেলার দৃষ্টান্ত থাকলেও ধর্ষিতার পরিবার-আত্মীয়স্বজন কিংবা এলাকাবাসীর ওপর সংঘবদ্ধ সহিংস আক্রমণ হয় না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে তাই হচ্ছে।
কণিকা দেওয়ান বলেন, ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে যে ভয়াবহ হামলা-ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে, তার রেশ এখনও কাটেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান না হলে নারীদের নিরাপত্তার হুমকি দূরীভূত হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবসের ১০ দফা প্রস্তাবনা উত্থাপন করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভানেত্রী কণিকা দেওয়ান।
সমাবেশ থেকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিতে ১০ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এগুলো হলো-
১। জাতিসংঘের অংশগ্রহণ ও তত্ত্বাবধানে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতে এবং ১ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা-ধ্বংসযজ্ঞের তদন্ত পরিচালনা করতে হবে।
২। খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে ধর্ষক সোহেল রানার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের হীনউদ্দেশ্যে দায়েরকৃত ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং এ নিয়ে এলাকায় অন্যায়ভাবে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীকে হয়রানি করা যাবে না।
৩। ধর্ষণের মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রদানে সেনা কর্তৃপক্ষের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।
৪। খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে ধর্ষণের শিকার কিশোরীসহ এ যাবৎ ধর্ষণের শিকার নারী-কিশোরীদের মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকার-প্রশাসনকে সমস্ত রকম আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
৫। কল্পনা চাকমা’র চিহ্নিত অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস গংকে বিচারের সম্মুখীন করা; রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগুদু উপজেলার করল্যাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধর্ষক আব্দুর রহিমের জামিন বাতিল এবং জালিয়াতির জন্য তার বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ; কুমিল্লায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে সোহাগী জাহান তনু’কে ধর্ষণ ও খুনের অপরাধীদের বিচার; খাগড়াছড়ি সদরের বলপিয়া আদামে প্রতিবন্ধী ধর্ষণ, রামগড়ের পদাছড়ায় গৃহীনী ধর্ষণ; রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি-কাপ্তাইয়ে সেনা কর্তৃক কিশোরী ধর্ষণ, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার দেওয়ানপাড়া-লক্ষীছড়িতে স্থানীয় দুর্বৃত্ত কর্তৃক ধর্ষণ ঘটনার বিচার করতে হবে।
৬। সরকারিপত্রে অমুসলিম নারীদের ‘বেগম’ সম্বোধন পরিহার করতে হবে।
৭। সংবিধান সংস্কার কমিশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল থেকে আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৮। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী-শিশুদের নিরাপত্তা বিধানসহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবিলম্বে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে নির্বাচন দিতে হবে।
৯। বাঘাইহাট বাজার ও অন্যত্র উৎপাতসৃষ্টিকারী সেনা মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।
সমাবেশে উপস্থিত সকলে উক্ত প্রস্তাবনাগুলোর প্রতি সমর্থন জানান। কণিকা দেওয়ার অবিলম্বে উত্থাপিত দশ দফা প্রস্তাবনা বাস্তবানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এস চাঙমা সত্যজিৎ
স্টাফ রিপোর্টার প্রথম বুলেটিন।