স্ত্রীর নামে আটটি নার্সিং কলেজ * ১৪ বছরে অনেককে সরকারি চাকরি দিয়েছেন * অর্থ লেনদেনের অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার
জাহিদ হাসান
২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
চিকিৎসা
Advertisement
বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ ইমরুল কায়েস। এই পদবি ব্যবহার করে নিয়োগ বাণিজ্যের পাশাপাশি বিধিবহির্ভূতভাবে একাধিক বেসরকারি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এভাবে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন ইমরুল কায়েস। আর সেই টাকা দিয়ে স্ত্রী তানজিনা খানকে ‘ট্রমা ম্যাটস ও শ্যামলী ম্যাটস’ নামে দুটি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক অংশীদার করেছেন। বর্তমানে তার স্ত্রীর নামে আটটি নার্সিং কলেজ রয়েছে।
সবশেষ ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রস্তাবিত ‘মডার্ন নার্সিং কলেজ’ অনুমোদন নিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে ইমরুল কায়েসের বিরুদ্ধে। এ কারণে ১৯ মার্চ স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। তদন্ত কমিটি নিজের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনে জন্য আজ তাকে কার্যালয়ে ডেকেছে।
Advertisement
জানতে চাইলে ইমরুল কায়েস যুগান্তরকে বলেন, ‘যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর কিছু ২০১৪-১৫ সালের দিকের ঘটনা। অফিশিয়ালি তদন্ত করার পর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এ মর্মে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব মহোদয়ের একটি ছাড়পত্রও আমার নেওয়া আছে। সেসব ডকুমেন্টস সংরক্ষিত আছে।’
‘আর বর্তমান অভিযোগের বিষয়ে ২৭ মার্চ (আজ) তদন্ত কমিটি আমাকে ডেকেছে। সেখানে যাব। মূলত একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ফের উঠেপড়ে লেগেছে। যাদের সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়।’
তিনি আরও দাবি করেন, ‘রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটার গঠনতন্ত্র ও প্রবিধানমালা অনুযায়ী আমি সেখানে চাকরি করলেও পরিবারের সদস্য কোনো ব্যবসা করতে পারবে না-এ ধরনের বাধ্যবাধকতা কিন্তু নেই।’ যদিও সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ১৭(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারী তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার বিষয়ে অনুমতি দিতে পারবেন না।’
অনুসন্ধানে জানা যায়-ইমরুল ২০০৪ সালে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি ও ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ) ক্যাশিয়ার হিসাবে নিয়োগ পান। ওই পদে থাকাকালে ইমরুল প্রভাব খাটিয়ে অসংগতিপূর্ণ শর্ত যুক্ত করে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নতুন সৃষ্ট পদটিতে ওই সময় পদোন্নতির যোগ্য ছিলেন প্রধান সহকারী মো. মনির হোসেন। কিন্তু তাকে বঞ্চিত করে হিসাবরক্ষক পদে মাত্র ৩ বছরের অভিজ্ঞতায় ২০০৯ সালে ইমরুল পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। এরপর থেকে প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-ছাত্রছাত্রীরা অনুষদ থেকে সার্টিফিকেট, মার্কশিট, নাম সংশোধন ও রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত অন্যান্য সব কাজের জন্য গেলে ঘুস দিতে হয়। কোনো উদ্যোক্তা বা প্রাতিষ্ঠানিক বা অ্যাকাডেমিক কোনো কাজে গেলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা রীতিমতো জিম্মি করে অর্থ আদায় করেন। এসব কর্মকাণ্ডে অনুষদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট (মামুন), ক্যাশিয়ার (আতিকুর রহমান), প্রধান সহকারী (রেহেনা) ও সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সিন্ডিকেট গ্রুপ সক্রিয়।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদে স্বামীর চাকরির সুবাদে ২০০৯ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. মো. রুহুল হকের ছেলে মো. জিয়াউল হকের সঙ্গে ইমরুলের স্ত্রী পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘বেসরকারি ট্রমা ম্যাটস ও শ্যামলী ম্যাটস’-এ কর্মরত আটজনকে ৩ সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।
যেমন-বাংলাদেশ চিকিৎসা অনুষদের হিসাবরক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন আগে শ্যামলী ম্যাটসে কর্মরত ছিলেন। ডেসপাস রাইটার নাদিরা বেগম শ্যামলী ম্যাটসে কর্মরত ছিলেন। ক্যাশিয়ার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ট্রমা ম্যাটসে কর্মরত ছিলেন। কম্পিউটার অপারেটর মো. শাকিল হোসেন ইমরুল কায়েসের খালাতো ভাই। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিয়োগ পাওয়া ডা. আফরিন জামান সহকারী রেজিস্টার ট্রমা উইমেন্সের (টাঙ্গাইল) কর্মকর্তা ছিলেন। বিএমডিসির হিসাবরক্ষক, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ইমরুলের ফুপাতো ভাই। মোহাম্মদ রাসেল মিয়া এমএলএসএস ইমরুলের প্রতিবেশী। নার্সিং কাউন্সিলে নিয়োগ পাওয়া শায়লা আক্তার ইমরুলের ফুপাতো বোন। এসব নিয়োগে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সচিব ডা. মো. জাহিদুর রহমানকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছেন কায়েস।
ঘুস ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ টাকা বৈধ করার জন্য ইমরুল কায়েস সামাজিক সংগঠন উৎসর্গ ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন। তার এই সংগঠনের অ্যাকাউন্টের মধ্যমে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম মডার্ন নার্সিং কলেজ অনুমোদন নিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি সৈয়দ জাহেদ হোসাইন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করেন ইমরুল কায়েস। চুক্তি অনুযায়ী ইমরুলের অফিসে এসে নগদ চার লাখ ৭০ হাজার টাকা পৌঁছে দেন সৈয়দ জাহেদ। এরই মধ্যে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তারসহ আরও দুজন চট্টগ্রাম মডার্ন নার্সিং কলেজ পরিদর্শনের জন্য যান। তবে ল্যাব কক্ষ ছোট হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল। এরপর জাহেদকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন ইমরুল। বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন জাহেদ। তার অভিযোগ আমলে নিয়ে ৮ মার্চ ইমরুল কায়েসকে সাময়িক বহিষ্কার করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
নিয়ম অনুযায়ী এই বহিষ্কারাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার কথা। তবে অনুষদের সচিব ডা. মো. জাহিদুর রহমানের সঙ্গে ইমরুলের বিশেষ সম্পর্ক থাকায় ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়নি।
এ বিষয়ে ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আগে তদন্ত শেষ হোক, তারপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে।
তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর বলেন, একটা নির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে গঠিত কমিটিতে আমাকে রাখা হয়েছে। ঘটনার আগে-পরের বিষয় এখনো জানি না। কাল (আজ বুধবার) তদন্তের জন্য রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদে যাব। সত্যতা প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগেও বাংলাদেশ প্রাইভেট আইএইচটি ও ম্যাটস প্রতিষ্ঠানের মালিক সমিতি ইমরুলের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি হাইকোর্টে চলমান আছে।