মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না, সেই অবস্থায়, মানুষ সে, বাঁচিবেই।

মো:আলমগীর হোসেন বিশেষ প্রতিনিধি তারাকান্দা ময়মনসিংহ।

মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না, সেই অবস্থায়, মানুষ সে, বাঁচিবেই।—কথাগুলো ভিখু সম্পর্কে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে। কিন্তু বাস্তবে ভিখুর মতো কঠিন-ক্রূর নন, বরং সম্পূর্ণ উল্টো চরিত্রের মানুষ, কাদাসদৃশ নরম যাঁদের মন-মানসিকতা, তাঁদের জীবনসংগ্রাম যেন ভিখুকেও ছাড়িয়ে যায়!

এতটাই কঠিন তাঁদের বেঁচে থাকা যে, তা যেন এক দিন, এক দিন করে বেঁচে থাকা! প্রতিদিনের ‘জীবন-রসদ’ প্রতিদিন জোগাড় করতে হয়; আজ কাজ না করলে পরদিন নিরম্বু উপোস!
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বয়স ৬০ ছুঁয়েছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ঠিকঠাক চলাফেরা করতে পারেন না, কিন্তু তাঁর এক দিনও জিরানোর উপায় নেই। প্রতিদিনই কাজে বেরোতে হয় তাঁকে; উপার্জন করতে হয় বৃদ্ধা মা, স্ত্রী-কন্যাসহ নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের অর্থ।
আরও পড়ুন
প্রথম বুলেটিনে
ঢাকার বাইরে সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শীত অনেকটাই কিছুটা গুছিয়ে পড়তে শুরু করেছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় যদিও এখন হেমন্ত, তবে ঢাকার মতো ‘কংক্রিট-অরণ্যে’ও রোদের তেজে নতজানু ভাব টের পাওয়া যায়।
যদিও বাতাস সেই আগের মতোই গরলে ভরা; প্রতিদিনই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ জায়গা দখল করে থাকছে আমাদের প্রিয় এ মহানগর। এর বাইরে আরেকটা ব্যতিক্রম, এ বছরের খ্রিষ্টীয় নভেম্বর বা বাংলা অগ্রহায়ণ গত বছরের বা তারও তিন বছর আগের এই সময়ের মতো নয়। কেননা, দেশের ‘নিজস্ব ক্যালেন্ডার’ অনুযায়ী এখন ‘ভোট ঋতু’।
এতে করে অবশ্য সব ঋতুতেই ফুটপাতে কলা বিক্রি করা জাহাঙ্গীরের দিনপঞ্জিতে কোনো হেরফের ঘটার উপলক্ষ তৈরি হয় না। রোজ ভোরে পুরান ঢাকার বাদামতলীর মেস থেকে বের হয়ে একই এলাকার পাইকারি বাজারে গিয়ে কলা কেনেন। এরপর তা নিয়ে বসেন বাবুবাজার সেতুর নিচে ফুটপাতে। কর্মঘণ্টা কলা বিক্রি শেষ না পর্যন্ত, কখনো কখনো তা রাত ৯টা-১০টায়ও গিয়ে ঠেকে।
জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা হয় গত ২৭ নভেম্বর। তখন ভরদুপুর। মাথার ওপর কোনো আচ্ছাদন না থাকায় রোদ পড়ছিল প্রায় খাড়াখাড়িভাবে তাঁর পুরো গায়ে। এরপরও বললেন, না, তেমন কোনো কষ্ট হচ্ছে না। এখন তো গরম কিছুটা কমতির দিকে, আর তা ছাড়া এত দিনের অভ্যাস।
তা কী সেই অভ্যাস? রোদে শুকিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে, গরমের হলকা সয়ে সয়ে গোটা জীবনটাই তো কাটিয়ে দিলেন, সে কথাটিই তাঁর মতো করে বললেন এই ম্লান মানুষটি।
জাহাঙ্গীরের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের জালালপাড়ায়। দুই মেয়ের মধ্যে বড়টির বিয়ে হয়েছে। ছোটটি আগামী বছর এসএসসি দেবে। জানালেন, বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপে। চার বোনের বিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর বিয়ে হয় বেশ দেরিতে, ২০০০ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন, তত দিনে বয়স প্রায় ৪০ ছুঁই ছুঁই।
কথায় কথায় জানা গেল, করোনার আগপর্যন্ত বাদামতলীতে জাহাঙ্গীরের একটা ঘর ছিল, কিন্তু করোনার ধাক্কায় তিনি সোজা ফুটপাতে এসে পড়েন। এখন ব্যবসার সম্বল বলতে হাজার কয়েক টাকা আর দুটি ঝুড়ি। ব্যতিক্রম বাদ দিলে দিনে গড়ে আয় থাকে চার থেকে ছয় শ টাকা। যে মেসে থাকেন, ভাড়া দিতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। হোটেলে খান। টাকা যা বাঁচে, তা পাঠান বাড়িতে। দেড়-দুই মাসে একবার বাড়িতে যাওয়া পড়ে।
আরও পড়ুন
প্রথম বুরেটিনে
জাহাঙ্গীর জানালেন, বাবার দেওয়া সেই পুরোনো ঘরেই এখনো পরিবার থাকে; সেটি ঠিকঠাক মেরামতও করতে পারেননি। একচিলতে জমি করতে পারেননি। আয়-ব্যয় সমানে সমান। অথচ গোটা একটা জীবন প্রায় কেটেই গেল!
কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও কথাটি সত্য—জাহাঙ্গীররা বংশপরম্পরায় কলার ব্যবসা করেন। তাঁর বাবাও তা–ই করতেন, দাদাও তা–ই। বংশের অন্যরাও কমবেশি সবাই এ পেশাতেই যুক্ত।
কলার মতো পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফল খাইয়ে যাচ্ছেন অন্যদের, আজীবন; অথচ নিজেরা ভুগছেন কিনা অপুষ্টিতে! তবু বেঁচে আছেন, মানুষ বলেই কি! জাহাঙ্গীররা কী রকমভাবে বেঁচে আছেন, তা কি তাঁরা কোনো ‘নিখিলেশদের’ বলেন—দেখে যেতে! কিংবা স্বেচ্ছায় কোনো ‘নিখিলেশ’ তাঁদের খোঁজখবর নেন?
এই ম্নান মানুষদের ‘অপুষ্টি’ কি কোনো দিন দূর হবে না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *