পৃথিবীতে মানুষের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। আর সবার আয়ুও নির্ধারিত। দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবন শেষে রয়েছে পরকালের সীমাহীন জীবন। এ দুনিয়ায় কেউ চিরকাল থাকবে না। সবাই মৃত্যুবরণ করবে। মানুষ এক একটি দিন অতিবাহিত করেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই জীবনের মূল্যবান সময়কে শ্রেষ্ঠ সম্পদ মনে করতে হবে। তা হিসাব করে ব্যয় করতে হবে। তাই আজ আমি প্রিয় পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। একজন মুসলমানের দিন এবং রাত কীভাবে কাটাতে হবে সেই সম্পর্কে আপনাদের কাছে, আমি হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী নিম্নে এমন একটি রুটিন তুলে ধরলাম।
ফজরের আজান হলে করণীয়
ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। এরপর এ দোয়াটি পড়া—‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আহইয়ানা বাদা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর’। অর্থ : সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি মৃত্যুর পর আমাদের জীবন দান করলেন এবং তাঁরই দিকে আমাদের পুনরুত্থান। হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে বিছানায় শোয়ার সময় নিজ হাত গালের নিচে রাখতেন, এরপর বলতেন : হে আল্লাহ! আপনার নামেই মরি, আপনার নামেই জীবিত হই। আর যখন ঘুম থেকে জাগতেন তখন বলতেন, সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি মৃত্যুর পর আমাদের জীবন দান করলেন এবং তাঁরই দিকে আমাদের পুনরুত্থান। (বুখারি, হাদিস : ৬৩১৪)।
ইস্তিঞ্জা করা : পেশাব-পায়খানার পর পবিত্রতা অর্জনকে ‘ইস্তিঞ্জা’ বলা হয়। শরিয়তে ইস্তিঞ্জার ওপর বিশেষ তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। ইস্তিঞ্জায় অবহেলা করাকে বড় গুনাহ এবং কবরে আজাবের কারণ বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবীজি (সা.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বলেন, এ দুজন মুর্দার ওপর আজাব হচ্ছে, (এ আজাব) কোনো কঠিন কারণে নয়। এদের মধ্যে একজন পেশাবের পর ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করত না… (বুখারি, হাদিস : ২১৮)। পেশাব-পায়খানার জন্য নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার আগে নিম্নের দোয়াটি পড়া উত্তম : ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবাইস’। অর্থ : হে আল্লাহ! আমি মন্দ কাজ ও শয়তান থেকে আপনার আশ্রয় চাই। পায়খানা বা ইস্তিঞ্জার পর ডান পা আগে দিয়ে বের হয়ে নিম্নের দোয়াটি পড়া উত্তম : ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আজহাবা আন্নিল আজা ওয়া ফানি’। অর্থ : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমার থেকে কষ্ট দূর করেছেন এবং স্বস্তি দান করেছেন।
মুখ পরিষ্কার করা : ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে, নামাজের আগে, কোনো মজলিসে যাওয়ার আগে এবং কোরআন-হাদিস পাঠ করার আগে মিসওয়াক/ব্রাশ করে মুখ পরিষ্কার করা মুস্তাহাব। (মারাকিল ফালাহ : ৫৩)। তবে ব্রাশ দিয়ে মিসওয়াকের সমান সওয়াব পাওয়া যাবে না। কেননা মিসওয়াকের মাঝে দুটি সুন্নত রয়েছে—(ক) দাঁত পরিষ্কার করা। (খ) গাছের ডাল দিয়ে পরিষ্কার করা। তবে হ্যাঁ, ব্রাশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করলে শুধু দাঁত পরিষ্কারের সুন্নত আদায় হবে। গাছের ডাল দিয়ে পরিষ্কারের সুন্নত আদায় হবে না। (দুররুল মুখতার : ১/২৩৬)
অজু করা : অজুকে নামাজের চাবি বলা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নামাজের চাবি পবিত্রতা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৬১)। তাই অজুর ফরজ, সুন্নত, মুস্তাহাব ইত্যাদির প্রতি ভালোভাবে খেয়াল করে অজু সম্পন্ন করা চাই।
ফজরের নামাজ পড়া : প্রথমে দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা আদায় করা। অতঃপর ফজরের দুই রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করা। কোনো কারণে ফরজের আগে সুন্নত পড়তে না পারলে, সূর্য উদিত হওয়ার পর পড়ে নেবে। ফরজ নামাজ বা জামাতের পরপর এ সুন্নতের জন্য দাঁড়ানো যাবে না। (দুররুল মুখতার : ২/৫৭)। আর সূর্যোদয় অবস্থায় নামাজের জন্য দাঁড়ানো যাবে না। বরং সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর নামাজে দাঁড়াতে হবে। ফজর নামাজ পড়া অবস্থায় সূর্য উঠে গেলে সেই নামাজ সূর্যোদয়ের পর কাজা পড়ে নিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৩২-৩৩)।
ফজরের পর করণীয়
ফজরের পর পড়ার মতো ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে। যেগুলো পড়ে মুমিন বান্দা নানাবিধ উপকার লাভ করতে পারে। নিম্নে কতিপয় আমল উল্লেখ করা হলো—
আয়াতুল কুরসি পড়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অন্তরায় থাকবে না।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ২৩৯৫)। সুরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াতটিই আয়াতুল কুরসি। তা হলো—‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কায়্যূম, লা তা’খুযুহু সিনাতুওঁ ওয়ালা নাউম। লাহু মা ফিস্ সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল্ আরদি, মান জাল্লাজি ইয়াশফাউ ইনদাহু ইল্লা বি ইজিনহি। ইয়া’লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খলফাহুম, ওয়ালা ইউহিতুনা বিশাইয়িম্ মিন ইলিমহি ইল্লা বিমা শা-আ। ওয়াসিআ কুরসিয়্যুহুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদা, ওয়ালা ইয়াঊদুহু হিফজুুহুমা,ওয়াহুওয়াল আলিয়্যুল আজিম।’ এ আয়াতটি পড়তে বেশি হলে এক মিনিট সময় লাগতে পারে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে পাঁচ মিনিট। দৈনিক ২৪ ঘণ্টা সময় থেকে পাঁচ মিনিট সময় ব্যয় করলে এ মহাপুরস্কার লাভ করা সম্ভব।
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দোয়া : যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা তিনবার নিম্নের দোয়া পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সন্তুষ্ট করবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৮৯)। দোয়াটি হলো, ‘রাজিতু বিল্লাহি রব্বাওঁ ওয়াবিল ইসলামী দ্বিনাওঁ ওয়াবি মুহাম্মাদিন নাবিয়্যা।’ অর্থ : আমি আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বিন হিসেবে ও মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার : যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা নিম্নের ইস্তিগফারটি পড়ে এবং ওই দিনে বা রাতে ইন্তেকাল করে, তবে সে জান্নাতি হবে। (বুখারি, হাদিস : ৬৩০৬)। উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বি, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা, খালাকতানি, ওয়া আনা আব্দুকা, ওয়া আনা আলা আহিদকা ওয়া ওয়া’দিকা মাস্তাতা’তু, আউজু বিকা মিন শাররি মা সানা’তু, আবুউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা, ওয়া আবুউ বিজাম্বি ফাগফিরলী ফাইন্নাহু লা ইয়াগিফরুজ জুনুবা ইল্লা আন্তা।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমি আপনার গোলাম। আমি আপনার ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির ওপর যথাসাধ্য আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। আমি আমার ওপর আপনার অনুগ্রহ স্বীকার করছি। আবার আমার গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দিন। কেননা আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহসমূহ ক্ষমা করতে পারবে না।
জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া : যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিবের পর সাতবার নিম্নের দোয়াটি পাঠ করে এবং ওই দিনে বা রাতে তার মৃত্যু হয় তাহলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৭৯)। দোয়া : ‘আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান্ নার’। অর্থ—হে আল্লাহ! আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করুন।
রোগব্যাধি থেকে হেফাজতের দোয়া : রোগব্যাধি থেকে হেফাজতের জন্য নবীজি (সা.) নিম্নের দোয়াটি পড়তেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৫৪)। দোয়া : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুজামি, ওয়া মিন সাইয়্যিল আসকাম।’ অর্থ—হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উন্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সব দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে।
সুরা ইয়াসিন পড়া : হাদিসে সুরা ইয়াসিন পড়ার অনেক ফজিলত বর্ণিত আছে। প্রতিদিন সকালে আমরা সুরা ইয়াসিন পড়তে পারি।
সূর্যোদয়ের পর করণীয়
সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট অতিবাহিত হলে ইশরাকের নামাজ পড়া সুন্নত। ইশরাকের নামাজ দুই বা চার রাকাত। এর নিয়ম সাধারণ নফল নামাজের মতোই। এ নামাজ পড়ার দ্বারা পূর্ণ একটি হজ ও ওমরাহ পালনের সওয়াব পাওয়া যায়। সব সগিরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এর নিয়ত এমন : নবীর সুন্নত দুই রাকাত ইশরাকের নামাজ পড়ছি, আল্লাহু আকবার।
ইশরাকের পর করণীয়
ইশরাক নামাজ পড়ে নাশতা করা। জীবন জীবিকার তাগিদে যার যার দুনিয়াবি কাজে নেমে পড়া। দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়া। কাজে ফাঁকি না দেওয়া। যার যার কাজে ইসলামী বিধান খেয়াল রাখা। হতে পারে তা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি কিংবা অন্য যেকোনো পেশার কাজ। তবেই সবার কাজ ইবাদতে পরিণত হবে।
ঘর থেকে বের হওয়ার দোয়া পড়া : যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিম্নের দোয়াটি পড়ে, তবে সে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে হেফাজতে থাকে, শয়তানের ধোঁকা থেকে দূরে থাকে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪২৬)। দোয়া : ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।’ অর্থ : আল্লাহর নামে, আল্লাহ তাআলার ওপরই নির্ভর করলাম, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই, শক্তিও নেই।
ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া ও বিসমিল্লাহ বলা : ঘরে প্রবেশকালে প্রবেশকারী সালাম দেবে ও বিসমিল্লাহ বলবে। এটি প্রিয় নবীর সুন্নত। যদিও প্রবেশকারী ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে বসবাস না করে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে, তখন সশব্দে সালাম দেবে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বরকতময় ও পবিত্র অভিবাদন।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৬১)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে ও খাবার গ্রহণকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করলে শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে, তোমাদের রাত্রিযাপন ও রাতের আহারের কোনো ব্যবস্থা (এ ঘরে) হলো না; কিন্তু কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমরা রাত্রিযাপনের জায়গা পেয়ে গেলে। আহারের সময় আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমাদের রাতের আহার ও শয্যা গ্রহণের ব্যবস্থা হয়ে গেল।’ (মুসলিম, হাদিস ২০১৮, আবু দাউদ, হাদিস : ৩৭৬৫)।
চাশতের নামাজ পড়া
কাজের কোনো ফাঁকে সম্ভব হলে চাশতের নামাজ পড়ে নেওয়া। চাশতের নামাজ দুই বা চার রাকাত, চার রাকাত পড়াই উত্তম। এর নিয়মও সাধারণ নফল নামাজের মতো। সূর্য এক-চতুর্থাংশ ওপরে উঠলে, গ্রীষ্মকালে ৯টা-১০টা, আর শীতকালে ১০টা-১১টার সময় সাধারণত তা আদায় করা হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করেছেন, যা আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো ছাড়ব না। তার একটি হলো চাশতের নামাজ। (বুখারি, হাদিস : ১১৭৮)। এর নিয়ত হলো, নবীর সুন্নত দুই রাকাত চাশতের নামাজ পড়ছি, আল্লাহু আকবার।
জোহরের ওয়াক্ত হলে করণীয়
জোহরের নামাজের ওয়াক্ত হলে উত্তম সময়ে জামাতের সঙ্গে (বর্তমান পরিস্থিতিতে যেভাবে সম্ভব) নামাজ আদায় করা। ফরজ নামাজের আগে-পরের সুন্নত গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা। সময় থাকলে দুপুরের খাবারের পর কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া। এটাকে কাইলুলা বলা হয়। কাইলুলা করা সুন্নত।
আসর ওয়াক্ত হলে করণীয়
আসরের ওয়াক্ত হলে চার রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করা। সম্ভব হলে ফরজের পূর্বের চার রাকাত সুন্নতও আদায় করা। উত্তম সময়ে আসরের নামাজ আদায় করা। কোনো কারণে আসরের নামাজ পড়া অবস্থায় সূর্য ডুবে গেলে আসরের নামাজ মাকরুহের সঙ্গে আদায় হয়ে যাবে।
প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও দ্বিনি দাওয়াতি কাজ করা। সরাসরি বা ফোনে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের খোঁজখবর নেওয়া। রোজাদার হলে ইফতার সামনে নিয়ে বসে দোয়া করা, সময় হলে ইফতার করা।
মাগরিবের ওয়াক্ত হলে করণীয়
মাগরিবের ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া। আজানের পর পর মাগরিবের নামাজ আদায় করা। তিন রাকাত ফরজের পর দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা আদায় করা। এরপর দুই দুই রাকাত করে ছয় রাকাত সালাতুল আওয়াবিন আদায় করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর কোনো অনর্থক কথাবার্তা না বলে ছয় রাকাত নামাজ পড়ে, তাকে ১২ বছরের ইবাদতের সওয়াব দেওয়া হয়। (তিরমিজি)
পাশাপাশি সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে প্রত্যেক রাতে সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করবে, সে কখনো অভাবের কষ্ট ভোগ করবে না।’ (বাইহাকি, হাদিস : ২৪৯৮)। ফজরের পরের আমলগুলো মাগরিবের পরও আদায় করা।
প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করা
প্রতিদিন হাফেজ নন এমন ব্যক্তির এক পারা কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত। যেন মাসে এক খতম পূর্ণ হয়ে যায়। হাফেজদের তিন পারা তিলাওয়াত করা উচিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরআন তিলাওয়াত করো। কেননা কোরআন কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮০৪)
যারা কোরআন না পড়তে পড়তে এমনভাবে ভুলে যায় যে দেখেও পড়তে পারে না। তাদের ব্যাপারে হাদিসে কঠিন শাস্তির ধমকি এসেছে। তারা কিয়ামতের দিন অঙ্গহানি অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৭৪)
যে কোরআন পড়তে জানে না, তার শেখার চেষ্টা করতে হবে। পড়তে না পেরে আয়াতের ওপর আঙুল ফিরালে তিলাওয়াতের সওয়াব পাবে না। কিন্তু কোরআনের প্রতি মহাব্বত প্রকাশের সওয়াবের আশা করা যায়। (মারাকিল ফালাহ : ২৫৯)। কোরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি সাধ্যমতো কোরআনের অনুবাদ, আমলের নিয়তে অর্থসহ হাদিস পাঠ এবং বিশ্বনবী (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহওয়ালাদের জীবনী পড়া উচিত।
এশার ওয়াক্ত হলে করণীয়
এশার নামাজের ওয়াক্ত হলে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া। সম্ভব হলে ফরজের আগের চার রাকাত সুন্নতও পড়া। উত্তম সময়ের প্রতি খেয়াল করে চার রাকাত ফরজ, দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও তিন রাকাত বেতের আদায় করা। নামাজের পর সুরা মুলক পাঠ করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, কোরআনের মধ্যে ৩০ আয়াত বিশিষ্ট একটি সুরা আছে। যেটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে মাফ করে দেওয়া হবে। সেটি হলো তাবারা কাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক (তথা সুরা মুলক)।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯১)।
এশার নামাজের পর করণীয়
এশার পর খানাদানা সেরে টিভি, মোবাইল ইত্যাদিতে অযথা সময় নষ্ট না করা। বরং নির্ধারণ করে নেওয়া যে আমি প্রতিদিন এতটার ভেতর শুয়ে পড়ব। ঘুম না এলেও সেই নির্ধারিত সময়েই শুয়ে পড়া। সারা দিনের ভালো-মন্দের হিসাব করা। সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া, কারো প্রতি কোনো ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ পুষে না রাখা। নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য তাওবা করা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। ভালো কাজের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা। পরবর্তী দিনটি যেন আরো উন্নত হয় সেই চেষ্টা করা। তার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।
নিদ্রার আগের আমল
ঘুমের আগে মিসওয়াক/ব্রাশ করে মুখ পরিষ্কার করে অজু করা। শুয়ে তাসবিহে ফাতেমি পড়া। তা হলো, ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদু লিল্লাহ’, ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’। কোনো পছন্দনীয় আমল থাকলে তা আদায় করা। যেমন—অনেকে সুরা ইয়াসিন পড়েন, অনেকে আয়াতুল কুরসি পড়েন, অনেকে চার ‘কুল’ পড়েন। অতঃপর ঘুমের দোয়া পড়া। ঘুমের দোয়া হলো—‘আল্লাহুম্মা বিসিমকা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া’। ডান কাতে শুয়ে ঘুমানো। জিকির করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া
শেষ রাতে ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার কিছু সময় আগে জাগ্রত হওয়া। তাহাজ্জুদ পড়ার চেষ্টা করা। তাহাজ্জুদ শেষ রাতের নামাজ। অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ নামাজ। নবীজি (সা.)-কে তাহাজ্জুদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং আপনি রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ুন। তা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। নিশ্চয়ই আপনার প্রভু আপনাকে মাকামে মাহমুদে (প্রশংসিত স্থানে) প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৭৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্কৃষ্ট নামাজ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১৬৩)।
সাহরি খাওয়া
রোজা রাখতে চাইলে রোজার নিয়তে সাহরি খাওয়া। সময়ের প্রতি লক্ষ করে সাহরি খাওয়া শেষ করা, আজানের প্রতি লক্ষ করে নয়। কারণ সাধারণত আজান দেওয়া হয় সাহরির সময় শেষ হওয়ার আরো পাঁচ মিনিট পর, আজান দেওয়ার পাঁচ মিনিট আগেই সাহরির সময় শেষ হয়ে যায়। তাই যারা আজানের সময় সাহরি খাবেন, তাদের রোজা হবে না।
বিশেষ সতর্কতা
কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। সারাক্ষণ ‘নেট দুনিয়ায়’ ঘোরাঘুরি করে মুক্তাতুল্য মূল্যবান মুহূর্তগুলো নষ্ট করা যাবে না। দেশের জরুরি খবরাখবরের পেছনে কত সময় ব্যয় করব—তাও নির্ধারণ করে নেওয়া উচিত। কোনো কথা শুনে সত্য-মিত্যা যাচাই না করে প্রচার করা যাবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৬)
নবীজি (সা.) বলেছেন ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনে তা-ই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫)
পুরুষরা কাজে না গেলে কী করবেন?
পুরুষরা কাজে না গেলে ঘরে স্ত্রী-পরিজনকে সময় দেবেন। সৎ ও সভ্য স্ত্রীরা তার স্বামী থেকে কামনা করে থাকে যে তার স্বামী যেন তাকে পর্যাপ্ত সময় দেন এবং তার কাছে থাকেন। উকবা ইবনে আমের (রা.) বলেন, আমি একদা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উভয় জাহানের মুক্তির পথ কী, তা জানতে চাইলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনটি উপদেশ দিলেন। তার একটি ছিল—পরিবারের সঙ্গে তোমার অবস্থানকে দীর্ঘ করবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০৬)। তবে পরিবারের সঙ্গে অবস্থান যেন নিছক দৈহিক উপস্থিতিই না হয়। যেমন—ঘরে তো আছেন কিন্তু টিভি, মোবাইল, ব্যক্তিগত কাজ বা স্ত্রীর কাজে ভুল ধরতে এতটাই নিমগ্ন, যা পরিবারের জন্য আরো বেশি পীড়াদায়ক।
ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা : ঘরে থেকে ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা যায়। ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা অনেকের কাছে কিছুটা লজ্জার বিষয় মনে হয়। এটি ঠিক নয়। নবীজির প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, নবীজি কি ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করতেন? তিনি বলেন—হ্যাঁ, নবীজি ঘরের লোকদের কাজে সহযোগিতা করতেন এবং নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য যেতেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৭৬)।
মুখেও ভালোবাসা প্রকাশ করা : ঘরে থেকে স্ত্রীদের সঙ্গে হাসি-মজা করা যায়। মুখেও মহব্বত প্রকাশ করা যায়। অনেকে স্বীয় স্ত্রীকে সীমাহীন ভালোবাসেন। অনেক সময় ভালোবাসার কথার জানানও দেন। কিন্তু মুখে প্রকাশ করাটাকে লজ্জার বিষয় মনে করেন। অথচ নবীজির সুন্নত মুখেও ভালোবাসার কথা প্রকাশ করা। খাদিজা (রা.) সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমার মনে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৪৩৫)।
আয়েশা (রা.)-কে বলেছেন, ‘সবার চেয়ে আয়েশা আমার কাছে এমন প্রিয়, যেমন সব খাবারের মধ্যে সারিদ আমার কাছে বেশি প্রিয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৪১১)।
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ভালোবেসে কখনো কখনো আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৭৪)
তিনি আরো বলেন, পাত্রের যে অংশে আমি মুখ রেখে পানি পান করতাম তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে পছন্দ করতেন। (মুসলিম, হাদিস : ৩০০)। তিনি বলেন, কখনো কখনো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতাম এবং আমাকে খুশি করতে তিনি প্রতিযোগিতায় ইচ্ছা করেই নিজেকে পেছনে ফেলে দিতেন। এ ছাড়া একই সঙ্গে গোসল করা, একই প্লেটে খাবার খাওয়া, একই চাদরে রাত্রিযাপনসহ অসংখ্য রোমান্টিকতায় ভরপুর ছিল নবীজির দাম্পত্য জীবন।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে জেনেবুঝে আমল করার তাওফিক দান করুন,আমিন।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।