মো: মাহবুবুল আলম (সুমন)
প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি)
পলাশীহাটা স্কুল এন্ড কলেজ , ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।
শুভ্র ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতিপ্রেমী। গ্রামের প্রান্তে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাতাসের মৃদু শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে তার খুব ভালো লাগত। দূরের সবুজ ধানক্ষেত, মাথার উপরে বিশাল নীল আকাশ, আর নদীর বয়ে চলা জলের শব্দ যেন তাকে এক অন্য রকম প্রশান্তি দিত। বৃষ্টি হলে শুভ্র ছাতা ছাড়াই ভিজে যেত, পাখির কণ্ঠের মতো তার মনের ভিতরও বয়ে যেত একধরনের সুর।
কিন্তু শুভ্র বড় হতে হতে বুঝতে পারল, তার ছোটবেলার সেই শান্ত প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। আবহাওয়া যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। শীতকাল ছোট হয়ে আসছে, গ্রীষ্মের তাপমাত্রা বাড়ছে দিনকে দিন। বৃষ্টি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, আর শীতল বাতাসের বদলে উঠে আসছে তপ্ত হাওয়া। শুভ্র একদিন তার মাকে বলল, “মা, আগে আমাদের গাঁয়ে শীতের সময় কত ঠাণ্ডা পড়ত! এখন আর সেরকম শীত থাকে না কেন?”
তার মা মাথা নেড়ে বললেন, “প্রকৃতির মেজাজ বড্ড খারাপ হয়েছে রে বাবা। আমরা মানুষই তো প্রকৃতিকে শোষণ করে চলেছি, এখন প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
শুভ্র সেই কথাগুলো অনেকদিন মনে রেখেছিল। সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তার বিষয় ছিল ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা। সে জানতে পারল, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর আবহাওয়া কীভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। খরার প্রকোপ বাড়ছে, কৃষি কাজের জন্য নির্ভরযোগ্য বৃষ্টির মৌসুম আর নেই। শীতকালে হিমালয় থেকে আসা শীতল হাওয়ার প্রবাহ কমে গেছে, আর বর্ষাকাল যেন আগের মতো নয়। প্রকৃতির প্রতিশোধের গল্পটি এখন শুভ্রের সামনে বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একদিন শুভ্র তার গ্রামের বাড়িতে ফিরল। সে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু আজ আর সেই শান্ত প্রকৃতি নেই। নদীর জল কমে গেছে, নদীর তীরে জমে উঠেছে পলিমাটি। খাল-বিল শুকিয়ে গেছে, মাটির গায়ে ফাটল ধরেছে। আকাশে কালো মেঘ জমলেও বৃষ্টি আসছে না। শুভ্রের মনে হলো, এই পরিবর্তন খুব অস্বাভাবিক।
রাতে শুভ্র তার দাদার কাছে বসে শুনছিলো পুরনো দিনের গল্প। দাদা বললেন, “তোর যখন জন্ম হয়নি তখন এখানে ছয় ঋতুর খেলা হতো। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত—সব ঠিক সময়ে আসতো আর প্রকৃতির চেহারা বদলে যেত একেক ঋতুতে। এখন দেখ, ঋতুর সেই পরিবর্তন আর চোখে পড়ে না। একটাই ঋতু—তপ্ত গ্রীষ্ম, মাঝে মাঝে বৃষ্টি দিয়ে একটু স্বস্তি, কিন্তু শীত আর সেই শীত নেই।”
শুভ্র তার দাদার কথা শুনে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল যে পৃথিবীর পরিবর্তন এখন তার হাতের বাইরে। মানুষ তার আধুনিকতার মোহে প্রকৃতির ওপর যে অবিচার করেছে, তারই ফল ভোগ করছে। পলিথিন, প্লাস্টিক, কল-কারখানার ধোঁয়া, অতিরিক্ত গাছপালা কাটা—সবকিছু মিলে বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীর আবহাওয়া এক বিপর্যয়কর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে শুভ্র সিদ্ধান্ত নিল যে সে কিছু একটা করবে। সে তার বন্ধুদের নিয়ে একটি গবেষণাগোষ্ঠী গঠন করল, যারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গবেষণা করবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে। তারা খুঁজে পেল যে, দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানি স্তর কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষির উপর প্রভাব পড়ছে ভয়াবহভাবে। তারা দেখতে পেল, কৃষকেরা আগের মতো ফলন পাচ্ছে না, আর গরমে অনেক মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
একদিন শুভ্র আর তার বন্ধুরা সিলেট অঞ্চলের একটি গ্রামে গেল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে। সেখানে তারা দেখল, চা বাগানের মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ কৃষক শুভ্রদের বলল, “বাবা, আমরা আর কতদিন এইভাবে টিকে থাকব জানি না। গরম এত বাড়ছে যে ফসল তোলা মুশকিল। চা গাছগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে।”
শুভ্র তাদের কথা শুনে দিশেহারা হয়ে গেল। সে জানত, এভাবে চলতে থাকলে দেশের বড় অংশ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। মানুষ খাবার, পানি, আর সহনশীল আবহাওয়ার খোঁজে শহরে চলে আসবে, যার ফলে নগরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ আরো বাড়বে।
শুভ্রর গবেষণা দলে ছিল অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা সবাই মিলে দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করতে লাগল। তারা জানাল, “আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে প্রকৃতির প্রতিশোধের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। আমাদের গাছ লাগাতে হবে, বনভূমি সংরক্ষণ করতে হবে, পরিবেশ দূষণ কমাতে হবে।”
কিন্তু মানুষ কি সেই ডাক শুনবে? নাকি শুভ্রদের মতো পরিবেশপ্রেমীদের লড়াই সেই চিরন্তন গরমের ঢেউয়ে হারিয়ে যাবে?
শুভ্র জানে, তার সামনে লম্বা পথ। কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। শুভ্র আর তার দল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছে, “এই গরম কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটি প্রকৃতির এক ধরনের প্রতিশোধ। যতদিন আমরা প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত না করব, ততদিন আমাদের জীবনে শান্তি আসবে না।”
একদিন রাতে শুভ্র নদীর পাড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেঘের ফাঁকে জ্বলজ্বল করছে তারার আলো। হয়তো প্রকৃতি তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে—যদি মানুষ সচেতন হয়, তবে প্রকৃতি আবার তার পুরনো রূপে ফিরে আসবে।