বিশ্বজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে চলার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তরুণ সমাজকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সুপ্ত সৃজনী শক্তি রয়েছে, তা জাগিয়ে তুলতে হবে। এর জন্য চাই জ্ঞানভিত্তিক গুণগত শিক্ষা, যার আলো তাদের অন্তরকে আলোকিত করবে, সম্ভাবনা ও সুপ্তশক্তিকে উন্মোচিত করবে, আত্মবিশ্বাসী ও কর্মোদ্যোগী করে তুলবে। আমরা জানি, জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান সৃজনী শক্তিকে পরিপুষ্ট করে, উন্নয়নের সিঁড়িকে করে মজবুত। জ্ঞানান্বেষণের প্রবল ইচ্ছা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্ম দেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত তৈরি করে, তেমনই নৈতিক শিক্ষাসভ্যতা ও সুশাসনের ভিতকে শক্তিশালী করে। জ্ঞানার্জনের ফলে তরুণরা নীতিনৈতিকতায়, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠবে। তারা তখন তাদের পছন্দনীয় কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে পারবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মী, ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা হিসেবে ছড়িয়ে পড়বে। উন্নয়নের বহুমুখী খাতগুলো তারুণ্যের পদচারণে মুখর হয়ে উঠবে। দেশে এখন তরুণসমাজের খুবই দুঃসময় চলছে। তাদের মধ্যে অনেক ঘাটতি ও হতাশা বিরাজ করছে। গুণগত শিক্ষায় পশ্চাদপদতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার অভাব, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতা, অপুষ্টি, চাকরি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, এসব সমস্যা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনার দ্বারকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এ ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপরাজনীতির শিকার, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, মাদকাসক্তি, প্রভৃতি কারণে বহু তরুণ আজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে।
এত কিছুর পরেও নতুন করে আশার সম্ভাবনা জেগেছে। সেখান থেকে বলতে চাই আদর্শগত রাজনীতির প্রয়োজন বাংলাদেশে। যেখানে তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি বিমুখতার প্রধান কারণ দেশের রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা না থাকা। বাবার কিংবা স্বামীর ছবি দেখিয়ে ভুলানো যাচ্ছে না নতুন মেধাবী প্রজন্মকে। তারা আদর্শগত অবস্থান জানতে চায়, জানতে চায় নীতিগত অবস্থান। তরুণরা অনেক সাহসী। বুড়োদের মত ভীরু নয়, কাজ করতে পছন্দ করে। এরা যেমন স্বপ্ন দেখে তেমনি স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে নিদ্রাহীন পরিশ্রম করতে জানে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের লেজুরবৃত্তিকে ঘৃণা করে ।
সময়টা এমন গেছে দেশে সুশাসন ও নীতিনৈতিকতার বড়ই অভাব বিদ্যমান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছিল। আদর্শ নেতৃত্বের অভাবে লুটেরা রাজনীতি দেশে অবাধ, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। দলীয় ও গোষ্ঠীগত চেতনায় জাতীয় চেতনাবোধ ছিল অবলুপ্তপ্রায়। ফলে দেশের তরুণ ও যুবসমাজ বিভ্রান্তি ও হতাশা কাটাতে রাজপথে নেমে এসেছে। সদ্য স্বৈরশাসক সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করে তরুণ সমাজ নোংরা রাজনীতি, সন্ত্রাস, নেশা ও কালোটাকার ছোবল থেকে প্রজন্মকে বাঁচাতে চায়। তাদের হাতে মাদক ও অস্ত্রের বদলে জ্ঞানের মশাল তোলে দিতে চায়। কেননা উদীয়মান মেধাবী এই তরুণ প্রজন্ম দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠী যাদের অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তরুণ প্রজন্ম জানতে চায় তারা কেন একটি রাজনৈতিক দল করবে । কি তার মূলমন্ত্র , কি তার মূলভাবনা । কি তার শিক্ষানীতি , কি তার সমাজনীতি , কি তার কুটনীতি, কি তার অর্থনীতি, কি তার বিজ্ঞাননীতি ইত্যাদি। পরবর্তি সময়ে কিভাবে তারা তাদের এইসব নীতি বাস্তবায়ন করবে । হিংসা, পরচর্চার দোষে দুষ্টু নয়, এরা বলতে জানে সত্য , বিশ্বাসও করে । এরা আকাশকে হৃদয়ে ধারণ করে যেখানে ঝড় যেমন উঠে তেমনি সুশীতল ঝর্ণা নামেও। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একজন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে জানতে চাই দুইজন নেতাকে নিয়ে বিতর্ক কতদিন? তাদের কাজের জন্য তারা চিরস্মরণীয়। একদল অন্য দলের নেতা সম্পর্কে অপমানজনক মন্তব্য করাকে পছন্দের চোখে দেখা বন্ধ করুণ। মাহাত্তা গান্ধী, আব্রাহাম লিংকন , জর্জ ওয়াশিংটন কে কোন দলের নেতা বলা হয় না , তারা জাতীয় নেতা। দুনিয়ার কোন নেতা-ই বিতর্কের উর্দ্ধে নয়। তাই বলে পিছন ফিরে তাকিয়ে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করলে দেশ এগোবে না ।
আজকের এই মেধাবী প্রজন্ম বিশ্বাস করে বাংলাদেশ তখন একটি অসুস্থ শিশুর মত জন্ম নিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমাদের সকল স্থাপনা করতে হয়েছিল। যেটা ১৯৪৭ সালে ভারত, পাকিস্তানকে করতে হয়নি ।১৯৭১ এর পর বহির্বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের শত্রুসুলভ আচরণ আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। অনেকের জানা আছে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যুক্তরাষ্ট্র নগদ টাকায় কেনা খাদ্য বোঝাই জাহাজ আসতে দেয়নি। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে আজ বাংলাদেশ সুস্থ কিশোর থেকে যৌবনে পা রেখেছে। তরুণপ্রজন্ম অনেক পজিটিভ চোখে দেখে এই বাংলাদেশকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আদর্শগত বারবার বিচ্চ্যুতির কারনে তরুণদের থেকে দূরে সরে গেছে । মেধাবীরা ভিড়তে পারে না রাজনৈতিক মঞ্চের আশেপাশে। ছাত্র নামের বখাটেদের হাতে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ভাবতেই শরীর হিমশীতল হয়ে আসে।
কি চায় তরুণ প্রজন্ম? ভাবার সময় এসেছে।মেধাবীদের সুযোগ দিতে হবে। বিসিএস, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ , গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। পূর্বে যারাই এসেছিল সবাই দলীয়করণ করে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয় আনা। এখন যাদেরকে স্বৈরশাসক বলে মুখে ফেণা তুলা হচ্ছে তাদের সাথে এক মঞ্চে না বসতে আদর্শগত মুল্যবোধকে জাগ্রত করা দরকার।
দেশের অনেক বড় বড় নেতার মুখস্থ করা কিছু বুলি আমাদের তরুণদের কোন আশার আলো দেখায়নি বরং আশাহত করেছে । এখন দেশকে ভালবাসার সময় এবং দেশের জন্য কাজ করার সময় । পুরোনো ইতিহাস ঠিকই জানে তরুণরা । তাই বলে পিছন ফিরে উল্টো হাটতে রাজি নয় তারা । বাণিজ্যনীতিগুলো দেশের মঙ্গলজনক হবে এটা প্রাণের দাবী তরুণদের । ভারতে তাদের গাড়ী শিল্পকে বাঁচাতে (এম্বাসেডর)গাড়ীতে ব্যাবহার করে তাদের মন্ত্রিরা (টেক্সি হিসেবেও ব্যাবহার হয় ওই গাড়ী)। কিছু বছর আগে তাদের চলচিত্রে দেশীয় গাড়ী ব্যাবহার ছিল বাধ্যতামূলক। সফটওয়্যার শিল্প প্রসারে আরো সাহায্য বাড়াতে হবে আমাদের নতুন সরকারকে। সরকার জানেও না হয়তো কত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে এই শিল্পে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে মিনিমাম ৬ মাসের শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ বাধ্যতামুলক করতে পারে সরকার। এতে শুধু সরকার লাভবান হবে না শিক্ষার্থীদের জন্যও ভাল হবে। গবেষনাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হোক। স্থাপনার নামকরণ করে মনে হয় না তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে স্থান করা যাবে। অন্যদিকে ইন্টারনেট যখন হাতের মুঠোয় তখন ফেসবুককে দোষ দেওয়ার বোকামি না করাই ভাল। দেশের মেধাবী প্রজন্ম যেখানে হাত দিয়েছে সেখানেই সোনা ফলেছে । সফটওয়্যার শিল্প, ঔষধ শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প , রেমিটেন্স প্রবাহ , বহির্বিশ্বে অধ্যায়নরত ছাত্ররা এই সেক্টরগুলোয় দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে । তাহলে রাজনীতিতে মেধাবীদের স্থান দেয়া হচ্ছে না কেন ? তবে কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভীরু । রাজনীতিতে জ্ঞানের চর্চা এত কম কেন? নতুনদের গ্রহণ করার ক্ষমতা এত কম কেন আমাদের রাজনীতিবিদদের । রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র এত শক্ত কেন? অন্য কোন ক্ষেত্রে এতো পরিবার তন্ত্রে প্রভাব নেই। এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না বলে ৭৪% তরুনেরা রাজনীতি বিমুখ । অবশ্য তরুণ প্রজন্ম এইসব প্রশ্নের উত্তর পেলে রাজনীতি মুখী হবে। মেধাবী প্রজন্মে ভরে উঠবে রাজনৈতিক অঙ্গন। ছাত্র নামের বখাটেদের হাত থেকে মুক্ত হবে আগামীর বাংলাদেশ।