today visitors: 5073432

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান : শেখ হাসিনার পতন এবং নতুন বাংলাদেশের সন্ধানে

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী

: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনা, যিনি দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার এই পদত্যাগের পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এই ঘটনার আগমুহূর্তে বাংলাদেশের রাজধানীসহ সারা দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, যা দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে অভ্যুত্থানের পথে : ২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে যে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা দ্রুতই একটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ক্রমেই ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু ছাত্র-জনতার ক্ষোভ ধীরে ধীরে একটি জাতীয় অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন শুরু হয় এবং আলীম উলামা, ইসলামী দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সহ দেশের সাধারণ মানুষও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়।
শেখ হাসিনার একটি বিতর্কিত বক্তব্য, যেখানে তিনি কোটা সংস্কারের প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি পাওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেন, তা আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারবিরোধী চেতনা আরও শক্তিশালী হয় এবং তাদের দাবিগুলো আরও দৃঢ়ভাবে সামনে আসে। এই উত্তাল পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ফলে বহু মানুষ নিহত হয়।
সহিংস দমন-পীড়ন এবং গণবিস্ফোরণ: সরকার প্রথমে এই আন্দোলনকে দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে পুলিশ এবং র‍্যাবের তৎপরতা বাড়িয়ে তোলা হয়। সরকারের নির্দেশে প্রশাসন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়। বিভিন্ন জায়গায় টিয়ারগ্যাস, জলকামান, এবং লাঠিচার্জের পাশাপাশি সরাসরি গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। এই সহিংস দমন-পীড়নের ফলে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন তরুণ শিক্ষার্থী।
এই সহিংসতার ভিডিও এবং ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, এবং তাদের সমর্থন আন্দোলনকারীদের শক্তি বাড়িয়ে তোলে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী এবং পেশাজীবীরা একত্রিত হয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। এই সময় আন্দোলনটি এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, সরকারের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জনমনে যে আক্রোশ তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমে একটি গণবিস্ফোরণে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং পালানো: অবশেষে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার প্রচণ্ড চাপের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, তার নিরাপত্তার জন্য তাকে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়। তিনি ভারতের একটি অজ্ঞাত স্থানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় হিসেবে দেখছেন।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা জানান এবং বলেন যে, দেশের সব কার্যক্রম এই সরকারের অধীনে চলবে। পাশাপাশি, সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ করান।
একটি নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা: শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। দেশজুড়ে যে সহিংসতা ও রক্তপাত ঘটেছে, তা মুছে ফেলার জন্য এবং জাতিকে একত্রিত করার জন্য এই সরকারকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়: শেখ হাসিনার ভারত পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত-হাসিনা সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল একটি বিশেষ দল নির্ভর । কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর এই সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এবং একই সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সচেতন থাকতে হবে।
নির্বাচনের দিকে ধাবমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে অবিলম্বে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা নতুন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ৫ আগস্টের এই ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি জনগণের আবেগ , শ্রদ্ধা অপ্রতিরোধ্য এবং তারা নিজেদের অধিকার রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত। বর্তমান পরিস্থিতি একটি নতুন বাংলাদেশের সন্ধানে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, যেখানে জনগণের ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে বলে সবাই আশা করছে।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জকিগঞ্জ উপজেলা সচেতন নাগরিক ফোরাম সিলেট।