মোঃ মিঠু আহম্মেদ নারায়ণগঞ্জ-
কোটা সংস্কার আন্দোলন কে ঘিরে ১৮ থেকে ২২ জুলাই নারায়ণগঞ্জে একপ্রকার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই সময়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং কারফিউ ভাঙকরা বিক্ষোভরতদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপে অন্তত আট জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। অনেকে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন।হাসপাতাল ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জুলাই আহত শতাধিক, ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধসহ আহত শতাধিক, ২০ জুলাই চার জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ আহত দেড় শতাধিক, ২১ জুলাই একজন নিহত ও আহত অর্ধশতাধিক এবং ২২ জুলাই তিন যুবকের লাশ উদ্ধার ও কয়েকজন আহত হন। আন্দোলনের সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জেলা কার্যালয়, পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশ বক্স, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশের গাড়ি, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডসহ ছোটবড় অর্ধশতাধিক স্থাপনা ও কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি ২৬টি বাস ও আরও ২০টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এখনও জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্র।
১৮ জুলাই যেভাবে আন্দোলনের মধ্যেই সংঘর্ষের সূত্রপাত... ?
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে শহরের চাষাঢ়া এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেন। দুপুরে পুলিশের একাধিক টিম বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এভাবে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। বিকালে বঙ্গবন্ধু সড়ক, নবাব সলিমুল্লাহ সড়ক ও পুরাতন সড়কে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের আরেকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দিনব্যাপী সংঘর্ষে শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। এদিন শহরের তিনটি মার্কেট, পুলিশ বক্স, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। রাতে সাইনবোর্ড এলাকায় পিবিআইয়ের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। একইভাবে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আগুন দেওয়া হয়। এতে পুরো জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজের পর শহরের ডিআইটি এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের প্রতিহত করতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নামেন। তিন দফায় তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গেও আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধসহ আহত হন শতাধিক শিক্ষার্থী। সন্ধ্যায় ডিআইটি এলাকার হাতিল ফার্নিচারের শোরুম, ডিআইটি ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান, গাজছুল আজম সিটি মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে মালামাল লুট করা হয়। সেইসঙ্গে নায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড, নম পার্ক, যুব উন্নয়ন কার্যালয়, এসবি ফ্যাশন গার্মেন্টসসহ অন্তত ২০-২৫টি স্থাপনা ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। শীতল পরিবহনের ২৬টি বাসসহ ছোটবড় আরও ২০টি যানবাহনে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার, সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের আটটি পিকআপভ্যান, দুটি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ভবন রক্ষার জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আব্দুল করিম বাবুর নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং সেখানে থাকা আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করে সিটি কর্পোরেশন ভবনে আন্দোলনকারীদের লাগানো আগুন নিভাতে
মন্ডলপাড়া ফায়ার সার্ভিসের দুই টি ইউনাইট নিয়ে আগুন নিভাতে সক্ষম হন। পর্বতীতে রাতে সড়কের পাশের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও ইটপাটকেল ছোড়া হয়েছে। ভাঙা হয়েছে জাতির পিতার ম্যুরাল ।
২০ জুলাই শনিবার সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জ জেলাতেও কারফিউ জারি করা হয়। দুপুরে কারফিউ ভেঙে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল ও চিটাগাংরোড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে শিমরাইল এলাকায় ইব্রাহিম খলিল মার্কেটে আগুন দেন আন্দোলনকারীরা। ওই ভবনের সাততলায় অবস্থিত হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দেওয়া হয়। খবর পেয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে ৩৭ পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে র্যাব। এদিন যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চার জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ দেড় শতাধিক আহত হন।
২১ জুলাই রবিবার সকালেও কারফিউ ভেঙে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল ও চিটাগাংরোড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়।
এতে একজন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন।সে সময় একজন সোনালী নামের একজন স্থানীয় নারী সংবাদ কর্মীর উপর নিশাংস হামলা করে কাউন্সিলর ইকবালের নেতৃত্বাধীন বিএনপির নেতাকর্মীরা ।এ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন নারী সংবাদকর্মী সোনালী ।
এদিন রাতে সেনাবাহিনীর টহল শুরু হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
২২ জুলাই সোমবার সকালে সাইনবোর্ড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হলে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তবে এদিন রাস্তায় দাঁড়াতে পারেননি তারা। যৌথ বাহিনীর অভিযানে শক্ত অবস্থানের কারণে পিছু হটে তারা। দুপুরের দিকে নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়ায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত থেকে শহরের বেশ কয়েক টি এলাকায় মোহড়া দেয় ওসি তদন্ত দিপক সাহার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার একদিক পুলিশ সদস্য।
বিকাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরপর শনিবার শিমরাইল এলাকায় ইব্রাহিম খলিল মার্কেটে আগুন দেওয়া ভবনটিতে তল্লাশি চালিয়ে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া তিন যুবকের মৃতদেহের ব্যাপারে মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করলে আগুনে পুড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শহরের খানপুর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক মো. আবুল বাশার প্রতিবেদক মোঃ মিঠু আহম্মেদ কে বলেন, পাঁচ দিন ধরে চলা সংঘর্ষে মারা যাওয়া দুজনের লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাদের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া ১৫৯ জন আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। অনেকের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জেলাজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেসব ঘটনায় আটটি মামলা হয়েছে বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ছয়টি এবং নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও নারায়ণগঞ্জ ফায়ার স্টেশন একটি করে মামলা করেছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের ১৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও অভিযান অব্যাহত আছে।’
একপ্রকার যুদ্ধ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছি উল্লেখ করে পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘প্রথমদিকে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিল। একটা পর্যায়ে দেখতে পেয়েছি, আন্দোলন ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে নেই। স্বাধীনতাবিরোধীরা আন্দোলনে ঢুকে নাশকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ কর্মকাণ্ড চালায়। আমরা সরকারি অফিস ও জানমাল রক্ষার্থে নাশকতাকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।’ জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমাদের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা আগুনে পুড়ে গেছে। সবকিছু হিসাব করলে বোঝা যাবে, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।