তানভীর ইসলাম আলিফ
কুমিল্লা (হোমনা) প্রতিনিধি
আশি সালের পর, এবং নব্বুই থেকে দুই হাজার হওয়ার প্রথমার্ধ —এই দেড় দশকের মাঝে যাদের জন্ম, সেই ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার ধরনে বৈসাদৃশ্য কম। কিন্তু এরপর সময় যতো এগিয়েছে, প্রজন্মের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন ঘটেছে খুব দ্রুত। তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, বিনোদনের ধরন, পড়াশোনার ধাঁচ, অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ —সবকিছুই বদলাচ্ছে চোখের পলকে। তবে নব্বুইয়ের কিছু পরে এবং দুই হাজারের কিছু আগে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম বোধহয় একইসঙ্গে বেশকিছু বৈচিত্র্যের স্বাক্ষী। যদিও তাদের ছোটবেলাটা ছিল খুব সহজ।
রুটিন ছিল এমন যে, সাতসকালে সবাই দলবেঁধে স্কুলে যাবে। বিকেলে ক্লাস শেষে বাসায় এসে কোনোরকমে দু'চারটা খেয়ে ছেলেরা বেরিয়ে পড়বে টেপ-টেনিস বল আর ক্রিকেট ব্যাট হাতে। এগুলো না থাকলে ফুটবল তো আছেই। অন্যদিকে মেয়েরাও বাইরে খেলবে এক্কাদোক্কা, কানামাছি; কেউ কেউ ছাদে ঘুড়ি ওড়াবে, অথবা ঝাঁপ দেবে পুকুরে —যেখানে চট করে দু’চারজনের একটু সাঁতার প্রতিযোগিতা হয়ে যাবে। এরপর সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফিরে যথারীতি পড়তে বসার কঠিন নিয়ম, তা না হলে বাবা অথবা মায়ের বেতের দু’চার ঘা পিঠে পড়তে পারে! এরপর পড়া শেষে রাতে কিছুক্ষণ টিভি দেখার সুযোগ মিলবে। কখনো কখনো তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতে হবে পছন্দের অনুষ্ঠানের অপেক্ষায়। জনপ্রিয় বিভিন্ন ধারাবাহিক নাটক, সিনেমা-সিরিয়াল, ছায়াছন্দ; আলিফ-লায়লা, ম্যাকগাইভার, বা মীনা কার্টুন সেই তালিকায় সবার ওপরে। বিদ্যুৎ না থাকলে, অথবা টেলিভিশনের অ্যান্টেনা কাজ না করলে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা তো যাবেই, সব ভাইবোন মিলে হইহুল্লোড় করে লুডু খেলতেই বা অসুবিধা কোথায়!
অন্যদিকে স্কুলের টিফিনের ফাঁকে লাইব্রেরিতে গিয়ে চট করে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা বা রহস্যপত্রিকা কিনে আনা, বাসায় পত্রিকা এলে খেলার পাতায় ডুব দেওয়া; সপ্তাহের কোনো এক ছুটির দিনে পত্রিকার সঙ্গে কচি-কাঁচার আসর বা অন্যান্য রঙিন গল্পের পাতার অপেক্ষা করে থাকার মুহূর্তগুলোও ভীষণ আনন্দের ছিল। সঙ্গী ছিল চাচা চৌধুরী, বিল্লু-পিঙ্কি, নন্টে-ফন্টে, হাদা-ভোঁদা, বাটুল দি গ্রেট এবং ফ্যান্টমও!
এই সহজ-সরল আনন্দমাখা অনুভূতি এখন বদলে গেছে। বিনোদনের বহু মাধ্যমের সবগুলো জায়গাই দখল করে নিয়েছে কম্পিউটার, স্মার্ট ডিভাইস ও ইন্টারনেট। আরও মোটা দাগে বললে, ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া। খালি চোখে মনে হতে পারে জীবনের দৈনন্দিন অনেক কাজ অনেকবেশি সহজ হয়েছে, যোগাযোগ বেড়েছে; কিন্তু আদতে অনেকের জীবন আটকে গেছে একধরনের জটিল-যৌগিক অঙ্কে। কী সেই অঙ্ক, সেই কথায় পরে আসছি। তবে তার আগে বলি, এতক্ষণ যে নস্টালজিয়ার কথা বলা হলো —সেই সময়টাই যেন টাইম মেশিনে চড়ে বহু মানুষের জীবনে অনেকখানি ফিরে এসেছিল এই কদিনের ইন্টারনেটবিহীন সময়ে। ভেবে দেখুন, মিল পাচ্ছেন?
আবার একটু পেছনে ফিরি। ইন্টারনেট এসে যে হুট করেই সব অভ্যাস বদলে দিয়েছে, তা কিন্তু নয়। এই পরিবর্তনটা হয়েছে ধীরে ধীরে, বিশেষত গত ১৫ বছরে। যেমন দুই হাজার আট, নয় বা দশ সালে দেশে ইন্টারনেট সবার জন্যই নতুন ছিল। গতিও ছিল একেবারেই কম। মোবাইল ফোনও তখন ‘স্মার্টফোন’ হয়নি। কিছু কিছু ফোনে জাভা-সাপোর্টেড অপারেটিং সিস্টেমে অপেরা মিনি, ইবাডি বা নিমবাজ মেসেঞ্জার ব্যবহার করা যেতো। কম্পিউটারে ব্যবহার হতো স্কাইপ এবং ইয়াহু মেসেঞ্জার। ফেসবুক নিয়েও তখন আগ্রহ বাড়ছিল, অনেকেই এতে পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি খুঁজে পেয়েছেন ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের। আবার কেউ কেউ ব্যবহার করতেন বিচিত্র সব নাম— নীল আকাশ, সাদা প্রজাপতি, লাল পরী, হলদে পাখি, ইত্যাদি! এসব অ্যাকাউন্টে অচেনা-অজানা মানুষেরাই ‘বন্ধু’ হতো। ফোনে ২০ টাকায় ২০ মেগাবাইটের একটা প্যাকেজ কিনলেই চলে যেতো বেশ কয়েকদিন। মডেমে ব্যবহার করা হতো ৩০০ টাকায় ১ গিগাবাইটের প্যাকেজ। সেটিও চলতো প্রায় মাসখানেক। সাদামাটা অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলোতে ছিল না কোনো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ভারী আকারের গ্রাফিক্সের ব্যবহার। ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক তখনও বহুত দূর কি বাত! এমনকি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আনলিমিটেড সংযোগের কথাও সেসময় কারোর চিন্তায় ছিল না।
এরপর বেশ দ্রুত প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। কম্পিউটারের কনফিগারেশন বেড়েছে, আনলিমিটেড ইন্টারনেটও সহজলভ্য হয়েছে; এসেছে থ্রিজি, ফোরজি এবং ফাইভ-জি। বিচিত্র অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী করে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন এবং ওয়েবসাইট দ্রুত ডেভেলপ হয়েছে। শুরুরদিকের সাদামাটা ফেসবুকে শুধু স্ট্যাটাস লিখা হতো, বড়জোর পরিবারপরিজনের সঙ্গে আনন্দের মুহূর্তের কিছু ছবি শেয়ার করা যেতো। এরপর যোগ হলো ভিডিও। পরের ধাপে কিছু গেম, যা দল হয়ে খেলা যেতো মেসেঞ্জারের মাধ্যমে। সেইসময়ের সাদামাটা ফেসবুক এখন সংঘাত-সংঘর্ষের খবরের ভিডিও, পোশাক-প্রসাধনীর দোকানের বিজ্ঞাপনী লাইভ, নানারকম রিলস, মার্কেটপ্লেসের অ্যাড, অন্যান্য প্রমোশনাল কন্টেন্ট, পত্রপত্রিকার ডিজিটাল সংবাদের বাহারি শিরোনামের লিংক, আর বহু সত্যমিথ্যার কানামাছি খেলায় ভরে থাকছে। এই ‘র্যাপিড ট্র্যানজিশন’ সবাই দেখেছেন, তাই ডিজিটাল দুনিয়ার এমন হয়ে ওঠার গল্পটা আর খুব একটা ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই।
তবে ইন্টারনেটের ব্যবহার অল্পদিনে সুলভ হয়ে উঠলেও আমরা বড়রকমের প্রস্তুতি বা যথেষ্ট সচেতনতা ছাড়াই সেই জগতে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে কোনো নিয়মতান্ত্রিকতার বালাই না রেখে বরং যথেচ্ছাচারই করেছি। ফলে এখন আমাদের সময় কাটে কীভাবে, বলুন তো? সকালটা শুরু হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আরও স্পষ্ট করে বললে—ফেসবুকে। কে কী শেয়ার করলো, তা দেখছি। ফিড স্ক্রল করলেই আসছে নানারকমের ভিডিও। সেসব দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এরপর ছুটতে ছুটতে অফিসে যাচ্ছি, সেখানেও যাত্রাপথে সঙ্গী ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক। অফিসের বিরতিতেও চোখ স্মার্টফোনের পর্দায়। ঘরে ফিরছি, সেখানেও এক রুমে থাকা দু’জন মানুষের চোখ দুইদিকে! ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন এতবেশি ‘ইনফরমেশন’ ও ‘কন্টেন্ট’ প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে আসছে, যা সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে।
যারা স্কুল-কলেজে পড়ছে, তাদের বিনোদন তো এখন পুরোটাই ডিভাইসকেন্দ্রিক। সোশ্যাল সাইট, ইউটিউব কন্টেন্ট এবং বিভিন্ন গেমসের ওপর নির্ভর করেই সময় কাটায় তারা। ছোটরা ফোনে ভিডিও দেখা ছাড়া খাবার খেতে চায় না, আর একটু বড়রা ব্যস্ত কোন ছবিতে বেশি লাইক আসবে, কোন ভিডিও ভাইরাল হবে, কোন বিষয়ে মন্তব্য করলে ‘রিচ’ বাড়বে —সেই অঙ্ক মেলাতে! এখন ফেসবুক বা অন্যান্য সাইটের বিভিন্ন ট্রেন্ডিং কন্টেন্ট প্রতিদিন আমরা যতোটা না কন্টেন্ট কনজিউম করছি, তারচেয়ে বরং নিজেরাই কনজিউমড হয়ে যাচ্ছি লাইক-শেয়ার-কমেন্টের এলগরিদমের জটিল হিসেব-নিকাশে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে কন্টেন্টের ধরন না মিললে আমাদের অঙ্কও মিলছে না। এতে করে আমরা একধরনের অস্থিরতায় ভুগি, নিজেকে কোনো এক অদৃশ্য দৌড়ের প্রতিযোগী ভাবি।
যাই হোক, গত কয়েকদিনের উত্তাল পরিস্থিতির কারণে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়টা যেন ফেলে আসা দিনগুলোর নস্টালজিয়া ফিরিয়ে এনেছিল ব্যাপকভাবে। বিভিন্ন জরুরি সেবা, অনলাইন ব্যাংকিং, ফ্রিল্যান্সিংসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেককিছু বন্ধ হয়ে পড়েছিল, সেটা সত্যি; ইন্টারনেট ছাড়া এখন আর আমাদের চলা সম্ভব নয়, সেটাও সত্যি। তবে কথায় আছে, ‘এভরি ক্লাউড হ্যাজ অ্যা সিলভার লাইনিং’। এই ক’দিন শহরের বাসার ছাদগুলোতে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছে, পার্কিং লটে বা গলিতে ক্রিকেট খেলেছে; যে বাচ্চাটি কখনো অনলাইন গেম ছেড়ে উঠতে চায় না —সেও বাধ্য হয়েছে সাপলুডুর বোর্ড খুলে বসতে। সময় কাটাতে ডিজিটাল কন্টেন্টের বিকল্প হিসেবে অনেকেই বেছে নিয়েছিল গল্পের বই, বাসায় জমে থাকা পুরনো কমিক, অথবা ছবি আঁকার ক্যানভাস। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ‘সময়ের অভাবে’ বাকি পড়ে কাজটাও সেরে ফেলতে পেরেছে। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে টেলিভিশনে ‘জি সিনেমা’ বা বাংলা নাটক দেখেছেন, যেটি এখন ইউটিউব থাকায় আর দেখা হয়ে ওঠে না। টিভির খবর দেখার অভ্যাসটাও যাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, তারাও এই কদিন নির্ভর করেছেন বিভিন্ন চ্যানেলের স্ক্রল আর বুলেটিনে।
আসলে প্রযুক্তি সুফলের মাধ্যমে জীবন বদলাতে গিয়ে বদলে গিয়েছিলাম আমরাই। এতে আমাদের ‘ব্রেন’টাই যে শুষে নিচ্ছিলো ইন্টারনেট, সেটিই বোঝা গেল এই কদিনে। একটা বিরতি পেয়ে কিছুটা পেছনে ফিরে দেখার সুযোগও হলো। এখন থেকে মাঝেমধ্যে নিজেরাই যদি ‘নো ইন্টারনেট ডে’ অথবা ‘নো ফেসবুক ডে’ পালন করি, সেটি হয়তো মন্দ হবে না। আপনার কী মত?