মোঃমনির মন্ডল,সাভারঃ সাভার মডেল থানার পাশে নিজ বাসায় ১৩ বছর আগে নৃশংসভাবে খুন হন সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম শামসুদ্দোহা খানমজলিসের স্ত্রী সেলিনা খানমজলিশ মেহের (৬৩)। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে আসামি না করায় পুলিশের একাধিক ইউনিট তদন্ত করেও কুলকিনারা করতে পারেনি। পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ১৩ বছর পর রহস্য উদঘাটন হয়েছে। শয়ন কক্ষের ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ডে খুনি রেখে গিয়েছিল ক্লু।
পুলিশ, ডিবি, সিআইডি চাঞ্চল্যকর এই খুনের কুলকিনারা করতে না পারলেও পিবিআই রহস্য উদঘাটন করে ঘাতকদের চিহ্নিত করেছে। এ ঘটনায় সাভার মডেল থানার ইলেকট্রিশিয়ান সুবল রায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তার জবানিতে এসেছে মর্মস্পর্শী এ ঘটনার সঙ্গে নিহতের বড় মেয়ে শামীমা তাহের পপি ও গৃহপরিচারিকা আরতিকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পিবিআই।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সাভারের সাবেক এমপির স্ত্রী হত্যা মামলার তদন্ত অনেকদূর এগিয়েছে, শেষ হতে আরো সময় লাগবে। তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে পিবিআই ঢাকার জেলার পুলিশ সুপার মোঃ কুদরত-ই-খুদা বলেছেন, ঘটনাটি যেহেতু স্পর্শকাতর এবং দীর্ঘ কয়েক বছর পর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে তাই তদন্তের স্বার্থে সব তথ্য এখনো জানানো যাচ্ছে না।
তিনি আরো জানান, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে তার বড় মেয়ে পপি, সুবল চন্দ্র রায় ও আরতিসহ মোট তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে পপি ও আরতিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পপির মেয়ের জামাতা আবুল কালাম আজাদকে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের সাব-ইন্সপেক্টর মো. ইমরান আহমেদ বলেছেন, গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার পপি ও আরতিকে ৩ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা তদন্তে সহায়ক তথ্য দিয়েছে। তিনি জানান, অনেক বছরের পুরানো এ ঘটনায় তদন্তে তিনটি কারণ সামনে এসেছে। এর মধ্যে পারিবারিক, রাজনৈতিক ও সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে। এ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিনজন কারাগারে রয়েছেন। সুবলের সঙ্গে নিহতের বড় মেয়ে পপির যোগাযোগ ছিল।
পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খুনের আগে ওই বাসার ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ডে সমস্যা হলে পপি ফোন করে সুবলকে ডেকে নেয়। খুনের পর সেই সুইচ বোর্ডে ও এর নিচে একটি ছবির এ্যালবামে সুবল ক্লু ও আলামত রেখে সটকে পড়ে। ভাঙা সুইচ বোর্ডের সূত্র ধরে গত ৩০ মে বিকেলে সাভার থানা সংলগ্ন রেজিস্ট্রি অফিসের অদূরে নেত্র বিজনেস সেন্টার থেকে সাভার মডেল থানার ইলেকট্রিশিয়ান সুবল রায়কে (৫২) আটক করে পিবিআই। এরপর তাকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠালে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে আদালতে পাঠানো হলে আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।
সুবলের বক্তব্যে পপি ও আরতির নাম আসলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুবলকে আটকের আগে ২৯ মে বুধবার সাভার পৌর এলাকার আড়াপাড়া মহল্লা থেকে স্বরস্বতী নামে এক মহিলাকে উত্তরাস্থ কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। আলোচিত খুনের তদন্তের পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত বলে জানা গেছে।
খুনের অন্যতম কারণ হিসেবে ধারনা করা হচ্ছে, শামসুদ্দোহা খানমজলিস ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য থাকাকালীন উত্তরায় একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি তার সম্বন্ধী (সেলিনা খানমজলিশের খালাতো ভাই) মুকিতুর রহমান ভূঁইয়ার (এম আর ভূঁইয়া) কাছে সেটি বিক্রি করে ফের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি হয়নি। খানমজলিসের মৃত্যুর পর ঢাকার বনানীর বাসিন্দা এম আর ভূঁইয়া জমি রেজিস্ট্রির জন্য সেলিনা খানমজলিশের কাছে গেলে সেখানে উপস্থিত তার দুই মেয়ে ও এক জামাতা আপত্তি করেন। এর কিছু দিন পর এম আর ভূঁইয়া মারা যান। উত্তরার এই প্লটে নির্মিত ভবনে খানমজলিশের কন্যা শিল্পী স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালাতো ভাই এম আর ভূঁইয়াকে প্লটটি রেজিস্ট্রি করে দিতে দুই মেয়েকে চাপ দেওয়াই সেলিনা খানমজলিশের জীবনে কাল হতে পারে।
আদালত পুলিশ জানিয়েছে, গত ১০ জুন নিহতের মেয়ে পপি ও বাসার ওই সময়কার গৃহপরিচারিকা আরতিকে ফের সাত দিনের রিমান্ডে আনতে আদালতে পাঠানো তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গত ৩ জুন সুবল রায় আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে আসামী সুবল রায় জানায় ভিকটিম সেলিনা খান মজলিশকে (৬৩) ঘটনার দিন (২০১১ সালের ১৪ জুন) ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে যেকোনো সময় নিহতের বড় মেয়ে শামীমা তাহের পপির (৫৫) সহায়তায় হত্যার উদ্দেশ্যে তার গলায় পোঁচ মারে। মামলার তদন্তকালে জানা যায় হাজতি আসামী আরতি সরকার ঘটনার সময় ঘটনাস্থল সাভার থানার পাশে ৯৬/৩ দক্ষিণপাড়ার বাসায় নিহতের বাড়ির দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করে বাড়িতে লোকজনের আসা যাওয়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত ছিল। গ্রেপ্তারকৃত সুরুল রায় (৫০) ও আসামী শামীমা তাহের পপির (৫৫) ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ঘটনার সময়ে উক্ত অপরাধ সংঘটনের সময় নিয়োজিত ছিল।’
- উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৪ জুন সাভার মডেল থানা সংলগ্ন দক্ষিণপাড়ায় নিজ বাসভবনে প্রতিবন্ধী পুত্র আব্দুল কাদের খানমজলিশ সেতুর সামনে হত্যার উদ্দেশে ফল কাটার চাকু দিয়ে সেলিনা খানমজলিশের গলায় পোঁচ মারা হয়। মেয়েদের চিৎকারে প্রতিবেশীরা গিয়ে মুমুর্ষ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইদিন পর মারা যান তিনি। বাসার নিচতলায় নিহতের দুই মেয়ে স্বামী-সন্তানসহ থাকতেন। নিহতের ছোট মেয়ে ইলোরা খানমজলিশ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন বিকেলে নিহতের ছোটভাই শাফিউর রহমান খান বাদি হয়ে সাভার মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।