today visitors: 5073432

বাংলার মালালা সাহিদার স্বপ্নযাত্রা

সাহসই শক্তি, সাহসই জীবন। এই সত্যটা আবারও প্রমাণ করল গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মেয়ে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। নিজের পরিবার ও সমাজের সাথে রীতিমতো লড়াই করে বাঁচিয়েছে নিজেকে, একবার নয় বহুবার। শুধু নিজেকে নয়, বাঁচিয়েছে আরও অনেক কিশোরীকে। বাঁচিয়েছে ‘বাল্য বিবাহ’ নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে। তার এ সাহসী লড়াইয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ। সম্প্রতি তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরষ্কার জয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের নামে তার উপাধি দিয়েছেন ‘বাংলার মালালা’।

নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘বিকজ আই অ্যাম অ্যা গার্ল’ এ নিজের জীবনের সংগ্রাম ও লড়াইয়ের বীরত্ব গাঁথা শুনিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত সবার মন কেড়েছে স্বর্ণা। জীবন যুদ্ধে তার লড়াইয়ের গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী তাকে ভূষিত করেন ‘বাংলার মালালা’ নামে।

দারিদ্র্য পীড়িত জীবন পেরিয়ে এক নতুন জীবনের পথে ছুটে চলেছে স্বর্ণা। শ্রীপুর থেকে অসলো। দূরত্বটা কম নয় মোটেও, প্রায় সাত হাজার কিলোমিটারের ব্যবধান। স্বর্ণা সর্বপ্রথম খবরে আসেন নিজের বাল্য বিবাহ ঠেকিয়ে।
তার এই সাহসিকতার খবর শুধু দেশেই আটকে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অনেক জায়গায়। এই খবর শুনে ২০১৩ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে সাংবাদিকদের একটি দল আসে তার সাক্ষাৎকার নিতে। বাল্য বিবাহ ঠেকাতে স্বর্ণার লড়াই নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে এই দল।

পরবর্তীতে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে নরওয়ে থকে আট সদস্যের একটি দল আসে তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। এরপর ওই বছরের অক্টোবরে স্বর্ণাকে নরওয়ের অসলোতে চারটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্বর্ণার, স্বপ্নের পথ চলা শুরু সেখান থেকেই।

স্বর্ণারা পাঁচ বোন, কোনো ভাই নেই। পুত্রসন্তান না থাকায় বরাবরই আক্ষেপ ছিল তার বাবা তোতা মিয়ার। এমনকি পুত্রসন্তানের জন্য দ্বিতীয়বার বিয়েও করেন তিনি। পাঁচ বোনের মধ্যে স্বর্ণা চতুর্থ। তার বড় তিন বোনেকে খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন তার বাবা। স্বর্ণার বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর, তখনই তার বাবা তাকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন।

কিন্তু স্বর্ণা তা মেনে নেয়নি। সে তার বাবাকে জানাল সে আরও পড়াশুনা করতে চায়, পড়াশুনা করে জীবনে বড় হতে চায়। ওই বারের মত সে নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল সাহসিকতার সাথে। এভাবে একবার নয় দুই দুই বার নিজের বিয়ে ভেঙে নিজ গ্রামে সাড়া ফেলে দেয় স্বর্ণা। পরবর্তীতে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় তাকে আবারও বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন তার বাবা। এবারও সে সাহসিকতার সাথে তার বিয়ে ঠেকাতে সক্ষম হয় স্বর্ণা। এবার সে আইনের আশ্রয় নেয়ার হুমকি দিয়েছিল সবাইকে।

শুধু নিজের বিয়েই নয়, এলাকার প্রভাবশালী লোকজনের সহায়তায় সে তার গ্রামের বহু কিশোরীকে রক্ষা করেছে বাল্য বিবাহ থেকে। স্বর্ণা নিজে বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন প্রায় ৩৫টি।

পরবর্তীতে বাল্য বিবাহ ঠেকানো ও শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য গড়ে তোলেন সূর্যমুখী শিশু ক্লাব।

গাজীপুর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষ পড়ুয়া স্বর্ণা পড়াশোনার পাশাপাশি এখন কাজ করছেন প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে স্বর্ণার স্বপ্নগুলো। এক সময় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা স্বর্ণা এখন স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষকতার মাধ্যমে সমাজ সেবা করার। তার স্বপ্ন এখন এ দেশের বঞ্চিত নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা। গাজীপুরের স্বর্ণা এখন সারা বাংলাদেশের নারীদের অনুপ্রেরণা, বিশ্বে নারীদের অগ্রযাত্রায় অনন্য এক উদাহরণ।