ষ্টাফ রিপোর্টার :
এটিএম রফিক সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কিছু বলা লাগে। কারণ তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আমি যতটুকু জড়িত ছিলাম, অন্য কেউ ততটা ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার সঙ্গে প্রথম দেখা এবং প্রথম দেখাতেই ঘনিষ্ঠতা, আলাপচারিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এটিএম রফিককে একজন সাধারণ মানুষ বা রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচনা করলে, ভুল করা হবে। কারণ ওনার যে বয়স ছিল, বয়সের তুলনায় তার ম্যাচুরিটি ছিল অনেক বেশি। ঘটনার নৈকট্য ও অব্যক্ততার সমন্বয় বিশ্লেষণে এটিএম রফিককে মূল্যায়ন করতে হবে তাকে দিয়েই, অন্য কাউকে দিয়ে নয়। এক কথায় বলতে গেলে রফিকের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করতে গেলে অন্ধের হাতি দেখার মতো। অন্ধ যেমন হাতি দেখে বলছে মুলার মতো, কখন বলছে কুলার মতো, কেউ বলে খাম্বার মতো। অর্থ্যাৎ যে যেই অংশে হাত দেয়, সে রকম তাদের বিশ্লেষণ। কিন্তু এটিএম রফিক একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন। কোনো ফ্যাশন, মিথ্যাচার ছিল না। যার কারণে অনেক জেনারেল-মন্ত্রী-এমপিদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অনেক সময় বক্তব্য দিতেন। এটিএম রফিকের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তেমন অনেক স্মৃতির মধ্যে বলতে গেলে, তাকে আমি বলতাম বাংলাদেশের ফাস্ট....., দ্রুততম মানব। কারণ রিকশা ছাড়া তিনি যতটুকু পদব্রজে যেতেন, তার সঙ্গে কেউ হেটে কুলাতে পারতেন না।
রফিকের সঙ্গে আমার শিক্ষা জীবনের সম্পর্ক ছিল। উনি সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ছিলেন, আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আমিও আইন ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। ক্লাসে একই সঙ্গে বসতাম দুজনে। তার একটা জিনিস ছিল, তাহলো জানার আগ্রহ এবং মানুষকে আপন করে নিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটা প্রবনতাও ছিল তার মাঝে। অল্প বয়সে ছাত্র জীবনে তিনি মাওলানা ভাষানী, খান এ সবুব, শাহ আজিজুর রহমান, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদ, এরকম নামকরা লোকদের সান্নিধ্যে আসেন এবং ঘনিষ্ঠ হন। তিনি প্রায় স্বপ্ন দেখতেন, যে একটা শোষণমুক্ত ও দারিদ্রমুক্ত সমাজের। তিনি প্রায় বলতেন, আই হেব এ ড্রিম, বাংলাদেশি ড্রিম। আমার একটা স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নটা বাংলাদেশি স্বপ্ন। বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য রাজনীতি-এখানে চাইলে অন্যকে অনুকরণ করা এবং গণতন্ত্রের উপর ছুরিকাঘাত করা কোনোভাবেই সহ্য করার মতো না। যখন বাকশাল প্রতিষ্ঠা হয়, তখন এটিএম রফিককে আমি খুবই কিংকর্তব্যবিমুখ হিসেবে দেখতে পাই। তখন উনাকে দেখলাম, এক দিন ব্যরিস্টার মইনূল ইসলামের বাসা থেকে আসছেন। তখন আমি উনাকে বলি, ওখানে গিয়ে কি লাভ হবে? সারাদেশের লোক আর্মি পুলিশ সবাই জয়েন্ট করছে বাকশালে। তখন এটিএম রফিক বলেন, দেখেন না কি হয়? সত্যি জেনারেল ওসমানি ও ব্যরিস্টার মইনুল, ওনারা দুজন বাকশালে যোগদান করলেন না। ছাত্র জীবনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন ফকির আলমগীর। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতা বিভাগে আমাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ ক্লাস মিট। সে প্রায় আমাদের রুম ৩২৭ জহুরুল হক হলে আসতো। সে সময়ে আমি একদিন দেখি, এটিএম রফিক নিজের খাবার ফকির আলমগীরকে দিয়ে তিনি সারারাত পানি খেয়ে কাটিয়ে দিলেন। তখন আমি বলি, আপনি এটা করেন, আবার পেছন থেকে ভাঙা গলা বলে ওয়ান মোর ওয়ান মোর।
তখন এটিএম রফিক আমাকে বলেন, আপনি জানেন না ওমর খৈয়মের কথা? বলেন তো, "ধুসর মরুর উষুর বুকে, যদি শহর গড়ো, একটি জীবন সফল করা তার চেয়ে বড়"। ফকির আলমগীর হয় তো একদিন এভাবেই বিখ্যাত হবে। ঠিকই বিখ্যাত হয়েছিলেন। রাজনীতির উত্তান পতন, এটিএম রফিক আগেভাগেই বুঝতেন। এটি ছিল, মরুভূমির মুর সম্প্রদায়ের লোকজন বাতাসে বালু উড়িয়ে বলতে পারেন, কখন ঝড় হবে বা ঝড় হবে না। ঠিক তেমন এটিএম রফিককে বাংলাদেশের "রাজনীতির মুর" বলা চলে। আজকে যারা রাজনীতির এদিক সেদিক এবং নিজেদের বড় মাপের বলে দাবি করেন, তাদের সামনে এটিএম রফিক অনেক বড় মাপের মানুষ। মনের দিক থেকেও তিনি অনেক বড়, তার ত্যাগ স্বীকার করার যে একটা অভ্যাস, তা না থাকলে তিনি অনেক আগেই মন্ত্রী-এমপি হতে পারতেন অন্তত। কিন্তু সেই মুহ ছিল না। তার ছিল কর্মী বান্ধব রাজনীতি এবং বাংলাদেশের মাটি মানুষের শিখর ছিল তার বিশ্বাসে। এটিএম রফিক শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। কারণ তিনি ছিলেন নেতা তৈরির কারিগর এবং নেতাদের নেতা। এটিএম রফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আইন বিভাগে পাস করে আইন পেশায় জড়াননি।
সাংবাদিকতায় এমএ পাস করে, সাংবাদিকতার টেবিলে বসেননি কখনও। আমি বলি, তাহলে আপনার এগুলো কি হবে? তখন উনি বলেন, এসব তো সামাজিক স্বীকৃতি, এজন্য এসব ডিগ্রি। এসব ডিগ্রি টিকে না প্রকৃতির পাঠশালার ছাত্র হিসেবে। আমি প্রকৃতির পাঠশালার ছাত্র হতে চাই। যেমনি মাওলানা ভাষানী, জন মেজর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মাও সেতুং চীনের নেতা, আব্রাহাম লিংকন, কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আরজ আলী মাতবর-এদেরর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কিন্তু প্রকৃতির পাঠশালার ছাত্র হিসেবে তাদের জ্ঞানের গভীরতা এমন যে, আটলান্টিকের গভীরতা আছে, কিন্তু তাদের জ্ঞানের গভীরতার তল ছিল না। বিশাল মাপের মানুষ এরা, তারা ঐশ্বরিক। এদের কাছে ডিগ্রির তুলনা চলে না। আমি আজকে উপস্থিতির জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, স্মরন সভা করছেন, কিন্তু এটিএম রফিক মরেন নাই, এই সংবাদটি আপনারা জেনে নিন। কারণ আজকের প্রদীপ্ত স্বহাস্য এই উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে, এটিএম রফিক মরেননি এবং তার আদর্শের মৃত্যু হয়নি। কারণ মানুষ মরতে পারে, কিন্তু তার আদর্শের মৃত্যু হলে আজকের এই সমাবেশ হতো না। তাকে অচিরেই ভুলে যেতো। কিন্তু আজকে এখানে যারা আছেন, তাদের আন্তরিকতা এবং স্বহাস্য উপস্থিতি প্রমাণ করে এটিএম রফিক তাদের কত প্রিয় মানুষ ছিলেন। আজকের রাজনীতির দূর্দিনে এটিএম রফিকের মতো মানুষের বড় প্রয়োজন ছিল।