today visitors: 5073432

কলামঃ “বিট্রিশদের নীলচাষের আদলে তৈরী যেন পোশাক কারখানা নিয়ম ও শ্রমিক আইন।”

ওমায়ের আহমেদ শাওন (লেখক, কলামিষ্ট ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক)

একটি দেশের অর্থনীতিকে বিপদে রাখতে একমূখী শিল্প কারখানা গড়ে তুলুন। সেই কাজটিই কে বা কারা এদেশে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে, তার দোষস্বরূপ কাউকে এককভাবে বলা যায়না। দেশের সিংহভাগ ট্যাক্স আসে এই পোশাক শিল্প কারখানা থেকে। যার ওপর সরকারও পোশাক শিল্প মালিকদের ওপর নির্ভর। অত্যন্ত সুকৌশলে মেহনতী জনগণের শ্রম বিক্রি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা দামে। সেই ব্রিটিশ আমলে নীলচাষীদেরও ব্রিটিশ সরকার নামমাত্র মজুরী দিতো। তখন নীল চাষ না করার জন্য বলপ্রয়োগ করতো। এখন যুগের প্রভাবে সেরকম বলপ্রয়োগ হয়তো করা লাগে না; দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দিলেই হয়। পোশাক শিল্প কারখানার ওপর পরিপূর্ণ ভাবে একটি দেশকে নির্ভর করাতে পারলেই হয়। অথচ পৃথিবীর এতো বিপদের মধ্যে কোন দেশ নেই। ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলো যদি হঠাৎ পোশাক নেওয়া বন্ধ করে দেয় (তাদের কাছাকাছি কোন দেশ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পোশাক সংগ্রহ করে) তাহলে নির্ঘাত এই উন্নয়নশীল দেশটি চরম বিপাকের মধ্যে পড়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট এই কারখানাগুলোর শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে করোনা মহামারীতে চাকুরী হারিয়ে কঠিন বাস্তবতার জীবনযাপন করছে সাড়ে তিন লাখের বেশী শ্রমিক।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’র (এমআইবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশের বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা অনেক বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। সিপিডি’র মতে, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি। মাত্র ৩.৬ শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনে বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে, ছাঁটাইকৃত কর্মীদের নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার সময় তাদের আরো কম বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে। তাতে বিপদগ্রস্ত শ্রমিকরা আরও বিপদের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারের নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।
সংসদের এসি রুমে বসে উন্নয়নের বাতেলা দিতে পারলেই সমগ্র দেশের উন্নয়ন হয়ে যায় না। উন্নয়ন শুধু ধনী ব্যবসায়ীদের জন্য করলে হবেনা। সকল জনগণের জীবন মান্নোয়নের জন্য একটি সরকারেক প্রচেষ্টা করা উচিত। মিডিয়া চ্যানেলে চটকদার প্রচারণা আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস।
নামমাত্র কিছু আইন পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য থাকলেও বেশিরভাগ মানবিক আইন কারখানাগুলোতে বাস্তবায়ন হয়না।
শ্রমিকদের বেতনকে কৌশলে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- বাসা ভাড়া, টিফিন বিল, যাতায়াত, ঔষধ ইত্যাদি। অথচ সুবিধা দেওয়ার নামে এসব চালাকি ও প্রতারণার কারণে মাস শেষে একজন শ্রমিক তাদের প্রাপ্য জীবনধারণের জন্য নূণ্যতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন না। ১২/১৪ ঘন্টা ডিউটি করে জীবনের বেশিরভাগ মূল্যবান সময়গুলো দিয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, অর্থের পাহাড় যারা গড়ে তুলছে দিনশেষে তাদের সংসার চালানোই কষ্টকর। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির কথা থাকলেও জেনারেল ডিউটির নামে চলছে অমানবিক কার্যক্রম। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও নারী শ্রমিকদের ওপর সুপারভাইজার, লাইনচিফ ও পিএম ছাড়াও জিএম, ইডিদের শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিয়মে গ্রুপ কোম্পানি গুলোতেও এসব নির্যাতন অহরহ চলছে। গ্রুপ কোম্পানি হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে প্রায় সকলেই ভয় পায়। র্গার্মেন্টস গুলোতে মাসিক বেতনের সেলারী শীট তিন-চার ভাবে করা হয়। একটি বায়ারদের দেখানোর জন্য আরেকটি শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য এভাবে। বায়ার বা তাদের প্রতিনিধি দল কারখানা পরিদর্শনে আসলে শ্রমিকদের মিথ্যে বলতে বাধ্য করা হয়। যেমন- শ্রমিকরা যথাযথ সুযোগ-সুবিধা পায়, ডিউটি প্রতিদিন ৮ কর্মঘন্টা ইত্যাদি। শ্রমিকদের জন্য শুধু নিয়ম-কানুন ও চাপ প্রয়োগের জন্য আইন বাড়ানো হয়, কিন্তু ন্যায্য বেতন বাড়ানো হয়না। গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের আইন-কানুন নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা দিয়ে জবাবদিহীতার মাধ্যমে যেটুকু আইন আছে তার সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব।
স্বাধীনতার এতো বছর পরেও একটি দেশে শ্রমিক-মালিকদের চুক্তি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
দেশের কোন মিডিয়া চ্যানেল পোশাক শিল্প মালিকদের অত্যাচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেনা তার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বেশীরভাগ মিডিয়া চ্যানেল-পত্রিকার মালিকই পোশাক শিল্প কারখানার মালিক। তারা জনগণকে শোষণ করার জন্য এমনভাবে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী তৈরী করেছে, যা কোন সরকার চাইলেও তাদের জুলুম দমন করা সম্ভবপর হচ্ছে না। কারণ, তারাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অসীন। প্রত্যেক পোশাক শিল্প কারখানায় নিজস্ব কিছু আইন আছে, সেগুলোই প্রয়োগ করা হয়। এতে শ্রমিকদের কোন বেনিফিট নেই। বরং তাদের নিয়মিত অত্যাচারিত হতে হয়। এখন কেউ বলতে পারে, তারা পোশাক শিল্প কারখানায় চাকুরী না করলেই তো হয়। প্রসঙ্গত, যখন একটি দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি পোশাক শিল্প কারখানার সাথে জড়িত তখন অন্য কোন শিল্প কারখানা খুঁজতে যাওয়া দরিদ্র জনগণের পক্ষে দুষ্কর। অধিকাংশ জনগণকে পোশাক শিল্পের দিকে ঠেলে দিয়ে এমন প্রশ্ন করাটা অবান্তর। সরকার যদি এই পোশাক শিল্পের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে অন্য কোন শিল্প কারখানার ওপর ব্যবসায়ীদের মনযোগ তৈরী করতে না পারে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই পোশাক শিল্প কারখানাগুলোর কারণেই সমগ্র দেশ কঠিন বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে। শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য, এনবিআর ট্যাক্স ও গার্মেন্টস মালিকদের লাভের পরিমানে বিস্তর ফাঁরাক। মালিকদের লাভের শতকরা কত পার্সেন্ট শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় সেটা সকলেই জানে।
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজার উদাহরণই বোঝা যায়, অধিকাংশ শিল্প কারখানাগুলো কতটা অনিরাপদ ও নাজুক। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমা ক্রেতা এবং অন্যান্য অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপের উদ্যোগে, দুটি ত্রিপক্ষীয় প্রকল্প – অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স – সূচিত হয়েছিল। এই প্রকল্পগুলির লক্ষ্য RMG (রেডিমেড গার্মেন্টস) উদ্যোগগুলির নিরাপত্তা মান বজায় রাখার জন্য একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ এবং পরিদর্শন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করে যায়। অথচ বিভিন্ন সময়ে এমন দূর্ঘটনার জন্য বহুতল ভবনে কারখানা চালুর আইন নিষিদ্ধ করা জরুরী।
ট্রেড ইউনিয়নের নামে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেগুলোও পোশাক শিল্প মালিকদের তৈরী। জনগণ, সরকার ও বায়ারদের চোখে ধোঁয়া দিয়ে তাদের অপকর্মগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
যখন একজন শ্রমিক চাকুরীর ওপর নির্ভর করে সংসার চালায় তখন প্রতিবাদ ও দাবী আদায়ের বিষয়গুলো থেকেও সরে আসে। কারণ, চাকুরী হারালে সংসার হুমকীর মুখে পড়বে। চাকুরী থেকে ডিসচার্জ ও ছাঁটাইয়ের ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের ওপর অমানবিকতা টিকিয়ে রাখে। অগত্যা শ্রমিকদের সবকিছু মেনে নিয়ে চাকুরী (ক্রীতদাসের মতো) করতে হয়।
কোন শিল্প কারখানার মালিক চায়না শ্রমিকদের জীবনমানের পরিবর্তন হোক। যদি শ্রমিকদের জীবনমানের পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে বেশী পারিশ্রমিকে তাদের নিয়োগ করতে হবে। চিরকালই কী তাদের এমন কৌশলের কাছে সরকার ও জনগণ থেকে যাবে অসহায়? দেশের সরকার জনগণকে জনসম্পদ হিসাবে তৈরী করতে চাইলেও এসব অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের জন্য সেটা সম্ভবপর হচ্ছে না।
বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের থেকে জেনেছি, তারা টানা ১৪/১৬ ঘন্টা দাঁড়িয়ে কাজ করেন। এটা কতটা অমানবিক ! গার্মেন্টস মালিকদের বছরে অন্তত একদিন হলেও এমন কাজ করা লাগলে হয়তো তারা এটার কষ্ট বুঝতে পারতো। সবকিছু বিশ্লেষণ করলে পোশাক কারখানার পরিবেশ ও আইন সেই ব্রিটিশ আমলের নীলচাষের মতোই। যারা এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে অতীত ঘটনা থেকে জানা যায়, সেসব প্রতিবাদী মানুষজন হত্যা বা গুমের স্বীকার হয়েছেন। ঠিক, ব্রিটিশ আমলেও এমনটি হতো।
শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন সম্পর্কিত মূল সমস্যা হল স্বল্প মজুরি। গার্মেন্টস সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি একটি সুস্থ জীবনমান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির চেয়ে অনেক কম। মজুরি বোর্ড প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকে প্রতিফলিত করে না। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ডের সামান্যতম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে, উপস্থিতি বোনাস এবং উৎসব বোনাসের মতো সুবিধাগুলি আটকে রাখা হয়। গ্লোবাল লিভিং ওয়েজ কোয়ালিশন (GLWC) অনুসারে জীবন ধারনের জন্য নূন্যতম মজুরি কেমন হবে তা বলা থাকলেও সেভাবে এদেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি প্রদান করা হয়না।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের অধীনে কারখানা পরিদর্শন বিভাগ (DIFE) কারখানার শর্তাবলীর সম্মতি পর্যবেক্ষণের কাজ করে। দুর্বল কাঠামো, দুর্নীতি এবং সরকারের আগ্রহের অভাবের কারণে এই সংস্থাটি সম্পূর্ণরূপে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের উচিত শিল্প কারখানার লাভের পরিমাণ বিবেচনা করে শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করা এবং দ্রব্যমূল্যের সাথে মানানসই বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দেওয়া।

লেখক: ওমায়ের আহমেদ শাওন
জন্ম: ২৩শে জানুয়ারি ১৯৯২ খ্রিঃ
বর্তমান ঠিকানাঃ মিরপুর, ঢাকা
হটলাইন: ০১৯১৩-৪৮৬০৭১।