ওমায়ের আহমেদ শাওন (লেখক, কলামিস্ট ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক)।
দিনমজুর, শ্রমিক, কর্মচারী মজুরীর বিনিময়ে চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান মালিকের কাজ করে থাকে। শিল্প-কারখানা, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিক শ্রমিকদের শ্রমের অবদান ও ত্যাগের মাধ্যমেই নিজের সম্পত্তি দেশ-বিদেশে বিনিয়োগ করে নিজের সম্পদ ও সুনাম বৃদ্ধি করে থাকে। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সকল শ্রমিকের অধিকার। কোম্পানির মালিকদের দায়িত্ব যেমন শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহন করা তেমনি সঠিক ভাবে মালিকপক্ষ সেটা করছে কিনা তার পরিদর্শনের দায়িত্ব রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এর পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা অনুযায়ী অধিক্ষেত্র সমূহ হলোঃ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতভুক্ত শিল্প, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠান, কৃষিখাত, কৃষিভিত্তিক খামার ও অন্যান্য সকল কর্মস্থল এর আওতাধীন। উল্লেখিত সব সেক্টরে নিয়োজিত সকল ব্যক্তির নিরাপত্তার নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন করা এ নীতিমালার সার্বিক লক্ষ্য-। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় মান নির্ধারণ করার মাধ্যমে শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবা, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পূণর্বাসন, শতভাগ নিরাপদ কর্মস্থল সৃষ্টির বিধি-বিধান এবং বিভিন্ন প্রণীত আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। শিল্প কলকারখানা বা পোশাক শিল্প মালিকদের একপেশে ক্ষমতাবলে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি সম্পর্কিত নীতিমালা সঠিকভাবে কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা হয়না। এজন্য ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, উন্নয়নশীল এ বাংলাদেশ চলমান পরিবর্তনশীল ও টেকসই উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। তাই নিরাপদ কর্মস্থল, কর্মক্ষম শ্রমিক এবং যুগ ও বাজার দরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরী নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীদের জন্য শতভাগ নিরাপদ এবং হয়রানিমুক্ত পোশাক শিল্প এখনো গড়ে উঠেনি। প্রায় সময় উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের দ্বারা নারীদের কু-প্রস্তাব ও যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়। নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হলে কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। দেশে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে জোড়ালো ভূমিকা রাখলেও বিভিন্ন মহলের অদৃশ্য তদবিরের কারণে শ্রমিকদের জন্য পরিপূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হয়নি। যেমন, শ্রম আইনের ১০৮ এর বিধান মোতাবেক অধিকাল ভাতা প্রদান সাপেক্ষে শ্রমিককে দিনে ১০ (দশ) ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করানো যাবে; কিন্তু অসংখ্য পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে শ্রমিকদের জোড়পূর্বক মাত্রাতিরিক্ত কর্মঘন্টা বাড়িয়ে দেয়। এ ব্যাপারে কোন শ্রমিক অতিরিক্ত কর্মঘন্টা করতে অস্বীকার করলে চাকুরী চ্যুত সহ নানান হয়রানি করার ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের ওপর জুলুম করা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে-। শ্রম আইন অনুসারে শ্রমিককে দুই ঘন্টা পূর্বে অবহিত করতে হবে; অধিকাল কাজের বিষয়টি। অথচ বাস্তবিক পক্ষে বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় সেটি অবহিত করা হয়না। বরং শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়মের মাধ্যমে সেগুলোকে শ্রমিকদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ মোতাবেক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে শ্রম আইনের সংযুক্ত ধারা ও বিধানসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেবলমাত্র শ্রমিক ও মালিকপক্ষের ন্যায্যতার মাধ্যমেই দেশে টেকসই উন্নয়ন সমেত দেশকে প্রকৃত ভাবে শিল্পমূখী করা সম্ভব। শুধুমাত্র শিল্প মালিকদের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন নয়। দেশের শ্রমিক ও জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের মধ্য দিয়েই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন জড়িত। সেজন্য শ্রমিকদের দাবি, অধিকার ও ন্যায্যতার ওপর সরকারকে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রায় প্রতি বছরই শোনা যায়, শ্রমিক অধিকার আন্দোলন হলেই পুলিশ গুলি করে শ্রমিকদের হত্যা করে। যার কোন সূরাহা হয়না, বিচার হয়না। সে বিষয়ে সংবাদ প্রচারেও নানা রকম বাঁধা প্রদান করা হয়। শিল্প কারখানার নানা সেক্টরে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে; কৃত্রিম কিংবা অকস্মাৎ কিন্তু বিচার হয় না তার। বিচারহীনতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, “দেশের অদম্য অগ্রযাত্রায় শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ জড়িয়ে আছে।” বাস্তবতায় দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, কারখানা উন্নত হলেও শ্রমিকের উন্নয়ন নেই। বর্তমান দেশের মধ্যে বিভিন্ন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠানে ৭ কোটি ৩০ লাখের বেশি শ্রমিক রয়েছে। যার বিপরীতে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন আছে পাঁচ হাজারের কম। তাও সেগুলোতে শিল্প মালিকদের হস্তক্ষেপ ও প্রভাব মারাত্বক ভাবে প্রভাবিত। হাতে গোনা কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া কেউ কথা বলারও সাহস রাখেনা। নামমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন দিয়ে মালিকের সঙ্গে দরকষাকষি বা শ্রমিক অধিকার চাওয়া হাসি-তামাশা ব্যতিত কিছু নয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অধ্যাপক ডা. একেএম রেজাউল বলেন, সব শ্রমিককে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনতে হবে। ইতিমধ্যে কমপ্লায়েন্স আওতাভুক্ত শিল্প কারখানা গুলোতে স্বাস্থ্য বিমা চালু হচ্ছে, যা প্রশংসনীয়। বর্তমানে শিল্প-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি দরকার। যেসব শিল্প-কারখানায় ০৩ হাজার বা তার চেয়ে বেশি শ্রমিক কর্মরত, তাদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে। বর্তমানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে শ্রমিকবান্ধব কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্প-কারখানার সুনাম বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তার ভালো প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে- 🗹 শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।🗹 শ্রমিকদের শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে। 🗹 কোম্পানির অন্যান্য খরচ কমে যাবে।🗹 বিশ্ব বাজারে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বাজার ভালো হবে। চাহিদা বাড়বে। 🗹 একই ধরনের অন্যান্য শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।🗹 শ্রমিকদের কাজের মান বৃদ্ধি পাবে। 🗹 শ্রমিক-মালিকের সু-সম্পর্ক তৈরী হবে।পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালাঃ১। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩২। বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৬৩। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০০৬৪। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ৫। বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫৬। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৯৭। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত ILO গাইডলাইন। শ্রম আইন সম্পর্কে শ্রমিকদের যথাযথ ধারণা না দেওয়ার কারণে শ্রমিকরা তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেনা। কর্মক্ষেত্রে আহত, নিহত শ্রমিক ও পরিবার সঠিকভাবে ক্ষতিপূরণ পায় না। এবং কারখানা গুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা না থাকার কারণে কর্মপরিবেশ মানসম্মত নয়। কেবলমাত্র সরকার, শ্রমিক ও কোম্পানি মালিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ সুন্দর করা সম্ভব। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না করলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন মানেই “স্মার্ট বাংলাদেশ।”