মতিন আব্দুল্লাহ
২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী
Advertisement
‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’... এ শুধু একটি গানের কথাই নয়, এক সময়ে মানুষ সত্যিই ছুটে আসত ঢাকা শহর দেখার জন্য। দেখার মতো ছিল সুবজে ঘেরা ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট, পার্ক, উদ্যান বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা। দিনে দিনে সেই স্বপ্নের শহর পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। এখন মানুষ চান কীভাবে অস্বস্তির শহর ঢাকা ছাড়বেন।
কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি কিংবা জীবিকার কাছে হার মেনে এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক সুবিধার এ শহরেই নানা প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে। এখানে বিপদ পায়ে পায়ে। বেইলি রোডের কাচ্ছি ভাই নামক অভিজাত রেস্টুরেন্টে পরিবার-পরিজনসহ খেতে গিয়ে কতগুলো মানুষের জীবন চলে গেল-সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে মনে হয়, এখানে ‘কোথাও কেউ নেই’। সবাইকে নিজ দায়িত্বে বাঁচার কৌশল খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু একটি মেগা সিটি কী এভাবে গড়ে উঠার কথা! এক ঘণ্টার বৃষ্টি বা তীব্র গরম-ঢাকার মানুষ কতটা কষ্ট ভোগ করে ভুক্তভোগী মাত্র ভালো জানেন।
Advertisement
একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে, ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগর-পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেড্ডেসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেছিলেন নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশ পরে আর বাস্তবে রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। এই নদীগুলোকে কেন্দ্র করে এক সময় মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো বহমান প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে শহরে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ।
এরপর ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরও একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এই মাস্টারপ্ল্যানের নাম ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। এই মহাপরিকল্পনা পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগের মতো সঠিক বলে নগর বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন।
এরপর কেটে গেছে ১৩ বছর। নগর বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় সংশোধিত ড্যাপ সুন্দর মহাপরিকল্পনা হলেও এই দীর্ঘ ১৩ বছরেও তার বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে বসবাস উপযোগী ঢাকার স্বপ্ন এখনো অধরা।
পরিকল্পিত নগর কতটা দরকার চলমান তীব্র দাবদাহ আরেকবার মনে করিয়ে দিল। ঘরের বাইরে বের হওয়া এখন রীতিমতো আতঙ্ক। কারণ কে কখন হিটস্ট্রোকের শিকার হন। এর থেকে বাঁচতে দরকার একটু শ্যামল ছায়া। কিন্তু ঢাকায় নেই সেই ছায়ার দেখা। যদিও ব্যতিক্রম রমনার হেয়ার রোড। সেখানে সবুজ-শ্যামল, ছায়া ঢাকা-পাখি ডাকা এক পরিবেশ। দুদণ্ড সময় কাটানো যায় অনায়াসে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওই সড়কের মতো ঢাকায় এমন স্বস্তির জায়গার এখন তীব্র সংকট। ঢাকায় জনজীবনে বইছে নাভিশ্বাস।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বসবাস উপযোগিতার জন্য যে কোনো শহরকে পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুলতে হয়। সুযোগ থাকার পরও ঢাকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এখনো যেটুকু সুযোগ রয়েছে, তাও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকার মানুষের কষ্ট ও জীবনমান আরও খারাপ হবে।
তারা মনে করেন, একটি শহরের ৬০ শতাংশ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ শতাংশ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের তাগিদে অবকাঠামো করা হয়। অথচ ঢাকার ক্ষেত্রে সেসব নিয়ম-কানুনের কিছুই মানা হয়নি। নগরের আয়তন বিচেনায় উন্মুক্ত স্থান, প্রশস্ত সড়ক-ফুটপাত, পার্ক, খেলার মাঠ, বা যে পরিমাণ জলাশয় রাখা দরকার ছিল, তা রাখা হয়নি। এটার প্রধানত দায়িত্ব ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশনের। কিন্তু এই দুই সংস্থার ব্যর্থতায় ঢাকা বাস-উপযোগিতা হারিয়েছে।
Advertisement
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে-চারশ বছরের পুরাতন শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান ৬০ শতাংশের স্থানে রয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ কম বা যা এক-তৃতীয়াংশের সমান। আবার বিভিন্ন অবকাঠামো ৪০ শতাংশের জায়গায় রয়েছে ৭৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ বেশি, যা দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া নগর এলাকার প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০ থেকে ১২০ জন মানুষ বসবাস করার কথা। অথচ ঢাকার প্রতি একরে বসবাস করছেন ৪০০ থেকে ৫০০ জন। যেটা প্রায় চারগুণ। এই হিসাব বলে দিচ্ছে-এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চারগুণের বেশি মানুষের বসবাস করছে। অর্থাৎ প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করে চলেছে প্রাণের শহর ঢাকা।
বাংলাদেশের নগরপরিকল্পনাবিদ পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ শতাংশ এলাকা কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। অথচ পরিকল্পিত এবং বাস-উপযোগী নগরের ১৫ শতাংশ জলাশয়, ২০ শতাংশ সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গা থাকা দরকার এবং সড়ক-ফুটপাত থাকা দরকার ২৫ শতাংশ জায়গা। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ শতাংশ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ শতাংশ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং মার্কেটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি হবে। কিন্তু ড্যাপের তথ্য বিশ্লেষণে ঢাকার প্রেক্ষাপটে বিস্তর ফারাক মিলছে।
সেখানে দেখানো হয়েছে-ঢাকায় বর্তমানে সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বসবাসকৃত এলাকার একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন। এছাড়া ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করেন; যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করেন; যা বিশ্বের তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করেন; যেটা বিশ্বের ১০ম
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, নগরের স্বস্তির জায়গা হলো-জলাশয়, পার্ক, খেলার মাঠ, সবুজ। ঢাকার এই গণপরিসর রক্ষার দায়িত্ব ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশনের। দুর্বল নেতৃত্ব ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার খেসারত এখন দিচ্ছে নাগরিকরা। এখনো কিছু সুযোগ রয়েছে; সরকার চাইলে সবুজ, জলাশয় বাড়াতে পারে। কিন্তু সেদিকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দৃষ্টি দিতে দেখা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে কিছু কাজ হয়, সেখানে লৌকিকতা বেশি। প্রচারণা মুখ্য উদ্দেশ্য। পরে আর পরিচর্চা করা হয় না।
Advertisemen
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ৩ ভাগের ১ ভাগের সমান। আর জনসংখ্যা রয়েছে ৪ গুণ অর্থাৎ ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে এই শহর। ঢাকায় ১২ ভাগের ১ ভাগ জনসংখ্যা থাকলে, সেটা ভালো হতো।
তিনি জানান, ঢাকার বর্তমান বাস্তবতায় পরিকল্পনার সবকিছু মেনে এই শহর আর গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তবে পরিকল্পিত উপায়ে কাজ করলে এখনো অনেকাংশে সবুজায়ন ও জলাশয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে সরকার এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
কর্তৃপক্ষের কথা : রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সংশোধিত ড্যাপে ঢাকার সবুজ ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা গেলে শহরের তাপমাত্রা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, রাজউক পরিকল্পনা করে দিয়েছে। সেখানে কোন কাজ কিভাবে করতে হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে সেসব বাস্তবায়নে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
তিনি জানান, ঢাকায় যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। নইলে এই শহরে বসবাস করা খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ না নিতে পারলে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মানুষ ঢাকা ছেড়ে যেতেও বাধ্য হবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এরফলে নগরজীবনে খুবই কষ্ট হচ্ছে। তাপমাত্রার লাগাম টেনে ধরতে সবুজায়ন বাড়াতে হবে। সিটি করপোরেশনের ফুটপাত, সড়কদ্বীপ, খাল, নদীর পারে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি জলাশয় বাড়াতে বেদখল জলাশয়গুলো দখলমুক্ত ও সংস্কার করার কাজ চলমান রাখা হয়েছে।
তিনি জানান, যে জায়গায় ভবন করা হয়, তার ৪০ শতাংশ সবুজ রাখা বাধ্যতামূলক। সেখানে বৃক্ষরোপণ ও মাটি রাখতে হবে। যাতে করে নিচে পানি যেতে পারে। সেই কাজটি কেউ করছে না। রাজউকে তা নিশ্চিত করণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় সবুজায়ন বাড়াতে মেয়রের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সড়ক ও ফুটপাতের গাছ রেখে উন্নয়ন কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি জলাশয় বাড়াতে খাল উদ্ধার করছেন। নগরজুড়ে সবুজায়নের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এছাড়া শহরের তাপমাত্রা কমাতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেও নতুন নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।