রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি * উন্নতি আর দুর্নীতি দুটোই পাশাপাশি এগিয়েছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
দুর্নীতি চক্র
Advertisement
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি। এ সময়ে দেশের সফলতা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি স্থায়ী ছিল দুর্নীতিও। উন্নতি আর দুর্নীতি দুটোই পাশাপাশি এগিয়েছে।
সাফল্যের বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক বেশি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির একটি চক্র গড়ে উঠেছে। আগামীর উন্নয়নে এই চক্র ভাঙতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। না হলে বাড়বে না সরকারের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা।
Advertisement
‘বাংলাদেশের ৫০ বছর : রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি (ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ : ইকোনমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার)’-শিরোনামের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। তাদের মতে, সবক্ষেত্রেই দেশে সুশাসন ও প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাব রয়েছে। কিন্তু এরপরও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ন হয়েছে। তবে এটি অলৌকিক নয়। এর নেপথ্যে কিছু বিষয় কাজ করেছে। এরমধ্যে রয়েছে-সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার সক্ষমতা, রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়), কৃষি উৎপাদন এবং গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি।
বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নিজ কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. রওনক জাহান।
ড. রেহমান সোবহান বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সফলতা চোখে পড়ার মতো। এ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে আর্থ-সামাজিক উত্তরণ ঘটেছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল। তখন ২৫ বছরের বাংলাদেশর অর্থনীতি নিয়ে এতটা উচ্চাশা ছিল না। সেখানে গার্মেন্টস সেক্টরে কতগুলো ভ্যালু অ্যাড হতে পারে, সে বিষয়ে চিন্তা করা হয়নি। রেমিট্যান্স নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করা হয়নি। এখন পরবর্তী ২৫ বছরে এসব পার্থক্য খুঁজে বের করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় রয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তারা বলেন, এতদিন দেশের উন্নয়নের যেসব চালিকা শক্তি ছিল, সেগুলো যে চিরকাল একইভাবে থাকবে না। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা) উত্তরণ হতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ এত দিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সেগুলো আর থাকবে না। ফলে যেভাবে অগ্রগতি হয়েছে, সেখান থেকে পিছলেও পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
তাদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্যারাডক্স আপাতত স্ববিরোধী বিষয় নয়। বিস্ময়করভাবে এই উন্নয়ন হয়নি। প্রথাগতভাবেই হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে বিভিন্ন নিয়ামকের সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে। এক্ষেত্রে দেশে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মিলন হয়েছে। সরকার ও বাজারের মধ্যে এক ধরনের মিথোজীবিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাই উন্নয়নের চালিকা শক্তি। ফলে সম্পদ বা সুশাসনের অভাব দেশের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তারা বলেন, এতদিন দেশের উন্নয়নের যেসব চালিকা শক্তি ছিল, সেগুলো যে চিরকাল একইভাবে থাকবে, তা নয়। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ হতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ এত দিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সেগুলো আর থাকবে না। বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে যেতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির বাইরে আরও কিছু বিষয় দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। সেটা হলো, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিপ্লব। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে টিকে থাকতে পারে। এই সক্ষমতার কারণে দেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের উন্নয়নের জগতে বড় একটি পরিবর্তন ঘটেছে। সেটা হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক দূরদৃষ্টি থেকে বর্জনকামী দূরদৃষ্টি। ফলে আগামীতে অর্থনৈতিক এজেন্ডা রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপ নেবে। জিল্লুর রহমান আরও বলেন, শিক্ষা এক সময় সামাজিক উন্নতির চালক ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের সস্তা শ্রমের ফাঁদে আটকে ফেলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যেও মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। অপরদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ ধনী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।
ড. রওনক জাহান বলেন, এর আগে যখন বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল, তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভালো জায়গায় যাবে। তখন অর্থনীতি নিয়ে ততটা উচ্চাশা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে, কিন্তু ভালো অবস্থায় আছে অর্থনীতি। তিনি বলেন, পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। সেটা হলো, পরিবর্তনের জন্য মূল্য দিতে হয়।
অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাত বিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে। উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার। এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন। দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বি^ত হয়েছে। সরকার যে সবকিছু করে দিয়েছে, তা নয় বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এখন এই সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আগে এই বিষয় যেভাবে কাজ করত, এখন সেভাবে করছে না।
সিপিডির আরেকজন বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, এই উত্তরণ তারই প্রতিফলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে। তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কিনা।
শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এতদিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চপ্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে উচ্চপ্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনাম এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে এটি আর সেভাবে কাজ করবে না। তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে এতদিন এক ধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল, অর্থাৎ এটা চলতে দিতে হবে। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ), না কি অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য নেই। তিনি বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আছে। এই চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, না হলে সংস্কার হবে না। বাড়বে না সরকারের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা।
অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, দেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন গড় সূচক নিয়ে কথা বলা হয়। এরমধ্য দিয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। তিনি বলেন, দেশে চরম দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে যেমন অসমতার হার সবচেয়ে বেশি। তেমনি ধনীদের ধন সঞ্চয়ের হারও অনেক বেশি। সে জন্য ধনী ও গরিবের সূচক পৃথকভাবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল হাসান বলেন, দেশের মানুষের শ্রম ব্যবহারের মধ্য দিয়েই উন্নয়ন হলেও যারা এই শ্রম দিয়েছেন, তাদেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। তার মতে, শিল্প খাতের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক কষ্ট করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মজুরি বাড়েনি। এ ছাড়া যারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন, তারা নানা ধরনের হয়রানি ও অধিকারহানির শিকার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন আপাতত স্ববিরোধী বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কীভাবে উন্নয়ন হলো, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়। বরং উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না, এখন সেটা বুঝতে হবে। জাহিদ হোসেন আরও বলেন, আমরা যেমন উঠতে পারি, তেমনি পিছলেও যেতে পারি