হক ফারুক আহমেদ
২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে সাত জলদস্যুপ্রবণ এলাকা
Advertisement
সমুদ্রপথে দেশের বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে সাতটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রুট ও স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো মূলত জলদস্যুপ্রবণ। এর মধ্যে রয়েছে সোমালিয়া উপকূল, ভারত মহাসাগরের গালফ অব ইডেন ও রেড সি, আরব সাগরের উত্তরাংশ, অফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল, গালফ অব গিনি ও ইন্দোনেশিয়ান উপকূলবর্তী অঞ্চল। সোমালিয়া ও গালফ অব গিনি সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর জায়গা। এখানেই সোমালি জলদস্যুদের অবাধ বিচরণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপথে বিশ্ব বাণিজ্যের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এই সমুদ্র অঞ্চল দিয়ে হয় বলে রুটগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা বলছেন, গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায় জলদস্যুতার মাধ্যমে জাহাজ জিম্মি করে উপার্জন অনেকের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ জিম্মি করে সোমালি জলদস্যুরা। এরপর থেকেই বিষয়টি আলোচনায়।
Advertisement
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সমুদ্রপথে বিশ্বের অনেক জায়গায়ই জলদস্যুতা আছে। তবে এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গা আমাদের জন্য বিশেষ আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
তিনি বলেন, সোমালিয়া উপকূল ও গালফ অব গিনি ভয়ংকর। এই দুই জায়গায়ই জাহাজ ছিনতাই হয়। এখানে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সোমালিয়ায় হতাহতের ঘটনা কম। কিন্তু গালফ অব গিনিতে জলদস্যুরা অনেক জাহাজের ক্রুদের নিয়ে গেছে, অনেককে মেরে ফেলেছে জাহাজেই। এটা আসলে একটা গ্লোবাল থ্রেড। এর বাইরে আমেরিকা, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলো ছাড়া অনেক দেশের বন্দরেই ছোটখাটো চুরির শিকার হয় আমাদের জাহাজগুলো।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে দেশের জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে সোমালিয়ান উপকূল, আফ্রিকান ইস্ট কোস্ট, গালফ অব এডেন, রেড সি ও আরব সাগরের উত্তরাংশ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। বিএসসির জাহাজের ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করি যতদূর সম্ভব এই অঞ্চলগুলো এড়িয়ে যেতে। কিন্তু সব সময় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। গালফ অব ইডেন বা রেড সি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ইউরোপে যেতে হলে রেড সি হয়েই যেতে হবে।
জানা গেছে, সোমালিয়ান জলদস্যুদের দ্বারা ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ৩৫৮টি জাহাজ ছিনতাই করা হয়। এগুলোর বেশিরভাগই বাণিজ্যিক জাহাজ। পরবর্তী সময়ে জাহাজ ও এর ক্রুদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই জাহাজ ছিনতাই ছিল মাত্র ৮টি। এক সময়ে জলদস্যুতার মাত্রা কমে এলেও এটি সাম্প্রতিক সময়ে আবার শুরু হয়েছে।
মেরিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আসা জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। জলদস্যুদের একটি গ্রুপ আছে যারা শুধু জাহাজ ছিনতাই করে। তারা ছিনতাই করা জাহাজ কিনারে নিয়ে এসে আরেকটা গ্রুপকে দেয়। তারা এই জাহাজের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ যারা পেশাগত ও প্রযুক্তিগতভাবে ছিনতাই হওয়া জাহাজের কর্তৃপক্ষ বা দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমঝোতা করে।
সোমালিয়ায় বর্তমানে জলদস্যুতা আয়ের একটি উৎস। এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, সোমলিয়ায় দীর্ঘ সময় গৃহযুদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে সেখানে নানা অন্তর্কোন্দলে দেশটিতে অনেকগুলো ভাগ হয়। এই ভাগগুলোতে নেতৃত্ব দেয় আবার কিছু যুদ্ধবাজ। যারা প্রাক্তন জেনারেল, রাজনীতিবিদ। এরা সবাই অত্যন্ত শিক্ষিত ও পেশাদার। জলদস্যুদের নেতৃত্বে আছেন এরা। এমনো শোনা যায়, সোমালিয়ান সরকারকে এরা অর্থায়ন করে।
তিনি বলেন, সোমালিয়ান উপকূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহু আগে এখানে টুনা ও সার্ডিন মাছের শিল্পকে ঘিরে মাছ ধরার ও সরবরাহের ব্যবসা ছিল। বিদেশি অনেক নৌকাও এখানে মাছ ধরত। গৃহযুদ্ধ এবং নানা কারণে এই মাছ ধরা শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সুযোগে অনেক বিদেশি রাষ্ট্র তাদের বিভিন্ন বর্জ্য এখানে ফেলছে। এক পর্যায়ে আর্মস গ্রুপগুলো তৈরি হয়।
মেরিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলদস্যুরা যখন জাহাজ ছিনতাই করার জন্য জাহাজে ওঠে তখন তারা খুবই সশস্ত্র অবস্থায় থাকে। জাহাজের ওপর থেকে যদি তাদের আগে থেকেই চিহ্নিত করা যায়, তাহলে দুর্ঘটনাটি এড়ানো যায়। সেক্ষেত্রে ক্রুদের ট্রেনিং থাকতে হয়। সাহসী হতে হয়। ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চললে তার লুক আউট থাকতে হবে। জলদস্যুরা একটি প্রধান জাহাজ থেকে নৌকাযোগে এসে আক্রমণ করে। তাই দু-একদিনের মধ্যে জাহাজের আশপাশ ঘিরে ছোট নৌকার চলাচল বাড়লে তা আমলে নিতে হবে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করলে বেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস (বিএমপি) জোরদার করতে হবে। গার্ড বহন করে কিংবা কোনো কনভয়ে যোগ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।