কাস্টমসের স্বেচ্ছাচারিতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) দিয়ে পণ্য আমদানি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
সিপাহি থেকে কমিশনার পর্যন্ত সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী হয়রানির অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। এতে আমদানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এ আইসিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে গত দুই সপ্তাহে একটি বিল অব এন্ট্রিও (বি/ই) জমা পড়ে
পানগাঁও আইসিটিতে কনটেইনারবাহী জাহাজ আসার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্টে ২৫টি জাহাজ আসে, পক্ষান্তরে সেপ্টেম্বরে এসেছে ৭টি এবং অক্টোবরে ৬টি।
অন্যদিকে আগস্টে আমদানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার এসেছে ৬৯৬টি, সেপ্টেম্বরে ১৬৭টি এবং অক্টোবরে ৬৪টি। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে পণ্য আসার সংখ্যা। মূলত কাস্টমসের হয়রানির কারণে ধীরে ধীরে কনটেইনার আসা আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
এ বিষয়ে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, পানগাঁও কাস্টমসের বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে গত মঙ্গলবার নৌ প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আমদানিকারকরা ও কাস্টমসের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। আমদানিকারকরা আমদানি কমিয়ে দেওয়ার কারণ জানিয়েছেন। আইসিটিকে গতিশীল করতে ইতোমধ্যেই সভার কার্যবিবরণী এনবিআরে পাঠানো হয়েছে।
৬ ডিসেম্বর কাস্টমস থেকে পানগাঁও বন্দরের টার্মিনাল ম্যানেজারকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। যাতে বলা হয়েছে, যুক্তিসঙ্গত কারণে কর্মকর্তারা যে কোনো যানবাহন থামিয়ে তল্লাশি করতে পারবেন। তল্লাশির জন্য যে কোনো দরজার তালা, সাজ-সরঞ্জাম অথবা মোড়ক ভেঙে ফেলতে পারবেন।
এ চিঠির পরপরই খালাস হওয়া পণ্যের ট্রাক গেটে আটকে দ্বিতীয় দফা তল্লাশি করা হচ্ছে। যদিও এ ধরনের তল্লাশির নজির অন্য কাস্টমস হাউজে নেই। এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেও সিএন্ডএফ এজেন্টরা প্রতিকার পাচ্ছেন না। মুখ বুঝে অনিয়ম সহ্য করছেন।
একাধিক আমদানিকারকের অভিযোগ-বিচারাদেশ টাইপ, সিএন্ডএফ লাইসেন্স নবায়ন ও আউটপাশ শাখার দায়িত্ব পালন করেন কমিশনার দপ্তরের এক কর্মকর্তা। তিনি আউটপাশ ইস্যু করতে ট্রাকপ্রতি ২ হাজার টাকা, বিচারাদেশ টাইপ করতে ৫০০-২০০০ টাকা ঘুস নেন।
কমিশনারের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকরা হয়রানি এড়াতে মুখ বুঝে তাকে ‘ম্যানেজ’ করেন। এমনকি কাস্টমসে কর্মরত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, কমিশনারের নাম ভাঙিয়ে নির্দেশনাও দেন।
হয়রানি-ঘুসগ্রহণ এবং বিল অব এন্ট্রি জমা না হওয়ার বিষয়ে জানতে শনিবার পানগাঁও কাস্টমসের কমিশনার আবু নূর রাশেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
একাধিকবার মেসেজের মাধ্যমে উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনোটিরই উত্তর দেননি। এরপর অতিরিক্ত কমিশনার মশিউর রহমানকে তার মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনিও কল রিসিভ করেননি। বিল অব এন্ট্রি না পড়ার কারণ জানতে চেয়ে একই নাম্বারে এসএমএস করা হলেও তিনি উত্তর দেননি।
২০২০ সালে পানগাঁও কাস্টমস রাজস্ব আয়ের প্রতিবন্ধকতা উল্লেখ করে এনবিআরে একটি চিঠি দেয়। সেখানে বলা হয়, চট্টগ্রাম থেকে কনটেইনার আসতে অধিক সময়ক্ষেপণ, অতিরিক্ত ব্যয়, নৌপথে পণ্য পরিবহণে ঝুঁকি এবং বন্দরের বাল্ক ও ব্রেক বাল্ক জাতীয় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা না থাকায় পানগাঁও আইসিটিতে কনটেইনার আনছে না আমদানিকাররা।
পণ্য পরিবহণে অধিক ব্যয় প্রসঙ্গে ওই চিঠিতে বলা হয়, পানগাঁও বন্দর থেকে রপ্তানি কম হওয়ায় আমদানি পণ্য খালাসের পরে খালি কনটেইনার চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে হয়। এ কারণে শিপিং কোম্পানিগুলো কনটেইনারের আপ-ডাউন ভাড়া আমদানিকারকের কাছ থেকে আদায় করে। ফলে আমদানিকারককে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হয়।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে কনটেইনার পানগাঁও আসতে সড়কপথের চেয়ে বেশি লাগে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও আসতে গড়ে ২২-২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এ নৌরুটে প্রতিদিন জাহাজ চলাচল করে না, এমনকি নির্ধারিত সময়সূচিও নেই। বিদেশ থেকে আমদানি পণ্যের কনটেইনার প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরে রাখা হয়। পরে পানগাঁও রুটের ধারণক্ষমতার সমান কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে জমা হলে তারপর জাহাজ পানগাঁওয়ের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। এক্ষেত্রে ৮-১০ দিন ব্যয় হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম পণ্য খালাস করে সড়কপথে ঢাকা আনতে ২-৩ দিন সময় লাগে।
একাধিক আমদানিকারক যুগান্তরকে বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমদানিকারকরা যখন পানগাঁও আইসিটিমুখী হচ্ছিলেন, তখনই কাস্টমস নানা উছিলায় হয়রানি শুরু করেছে। বন্দরটি অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
এক কর্মকর্তা পরীক্ষণ শেষে খালাসের জন্য ফাইল ছেড়ে দিলেও অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা। আমদানি পণ্যের রেফারেন্স ভ্যালু থাকার পরও মানা হচ্ছে না। দিনের পর দিন পণ্য বন্দরে পড়ে থাকছে। এরপরও শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খালাসরত পণ্য গেটে দ্বিতীয় দফায় তল্লাশি করা হচ্ছে। অন্য কোন কাস্টমসের এ বিধান নেই।
তারা আরও বলেন, পানগাঁও বন্দরে আমদানি পণ্যের এইচএস কোড সংক্রান্ত মতবিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। একই পণ্য আগে কাস্টমসে যে এইচএস কোডে খালাস হয়েছে, সেই পণ্যই বর্তমানে অন্য এইচএস কোডে ফেলে মিথ্যা ঘোষণায় অমূলকভাবে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। কেন এমন করা হচ্ছে, সে বিষয়ে কারো কাছেই সদুত্তর নেই। এক কথায় কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটতে চলেছে। আর সর্বস্বান্ত হচ্ছেন আমদানিকারকরা।