today visitors: 5073432

নওয়াজের স্বপ্নে গুড়েবালি, নতুন ‘তারকা’ মরিয়ম-বিলাওয়াল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে কারাবন্দি ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত প্রার্থীরা। কিন্তু এরপর সরকার গঠন করতে পারছে না দলটি। দলটির নেতারা বলছেন, তাদের প্রতি পাকিস্তানি জনগণের একচেটিয়া ম্যান্ডেট বা জনসমর্থন চুরি করা হয়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নির্বাচনে সম্ভাব্য অনিয়ম ও ফল কারচুপির অভিযোগগুলো তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে। পিটিআই ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ তীর্যক সমালোচনার মধ্যেই পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ (পিপিপি) ছটি দল জোট সরকার গঠন করতে চলেছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা পিএমএল-এন (৭৫টি আসন) ও পিপিপি (৫৪ আসন) গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে এক ঘোষণায় জানায়, তারা আরও চারটি দলের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (পিডিএম) আদলে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে। ছয় দল মিলে তাদের আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৫০টিরও বেশি। যেখানে প্রয়োজন ১৩৪টি।
 
ছয় দলীয় জোটে অন্য দলগুলো হলো মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএমপি), পিএমএল-কিউ, ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান (আইপিপি) ও বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)। তবে ‌ভোট ‘চুরি’ করেই হোক আর ‌’ডাকাতি’ করেই হোক, পিএমএল-এন শেষ পর্যন্ত সরকার গঠনের পথ করতে পেরেছে। কিন্তু সরকারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নয় বরং হচ্ছেন তার ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ।
 
এমনটাই জানিয়েছেন দলের মুখপাত্র মরিয়ম আওরঙ্গজেব (মরিয়ম নওয়াজ নয়)। মঙ্গলবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে তিনি বলেন, নওয়াজ শরিফ ছোট ভাই শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনিত করেছেন। কিন্তু কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট সরকার হলেও তা টিকবে না। এটা বুঝতে পেরেছেন নওয়াজ। আর সেজন্যই হয়তো শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করেছেন তিনি।
 
পাকিস্তানি সাংবাদিক মাজহার আব্বাস বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক যুদ্ধে হেরে গিয়ে থাকেন, তিনি আর কেউ নন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ৭৪ বছর বয়সী নওয়াজ শরিফ। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যার চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে।
 
নির্বাচন সামনে করে প্রায় চার বছর পর লন্ডনের স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে পাকিস্তানে ফিরে এসেছিলেন নওয়াজ। আসার আগে ও পরে এই নির্বাচনে জিততে এমন কোনো কার্ড নেই নেই তিনি খেলেননি। এরপরও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। 
 
মাজহার আব্বাস বলেন, এটা তার জন্য একটি শিক্ষার সুযোগ। ভুলটা কোথায় হয়েছিল তা উপলব্ধি করার। এছাড়া নওয়াজের কাছে ছোট ভাই শাহবাজকে ২০২২ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনীত করা এবং প্রিয় কন্যা মরিয়ম নওয়াজকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। পাঞ্জাব বিধানসভায় নির্বাচিত হলে মরিয়ম হবেন পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী।
 
মাজহার আব্বাস বলেন, নওয়াজ এখন সম্ভবত মেয়ে মরিয়মের অবস্থান শক্তিশালী করতে এবং পিএমএল-এনের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পাকিস্তানে থাকবেন। কারণ তার দল এখন তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রধানমন্ত্রী ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসা ফের (পিটিআই) কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আবারও সেই ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়।
 
নওয়াজের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার প্রায় শেষের পথে। তার দলও অর্থাৎ পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ২০১৩ সালের মতো অত শক্তিশালী নয়। দুর্নীতির মামলায় আজীবন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়ে ইমরান খানের সরকারের সময় ২০১৯ সালে তিনি যখন পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন, তখন পিএমএল-এনের অবস্থান ভালোই ছিল। বিশেষ করে পাঞ্জাবে। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্তের কারণে তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। যা গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট।
 
২০২২ সালের এপ্রিলের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোটের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় ইমরান খানের সরকার। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), ও জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলামের (জেইউআই-এফ) সমর্থনে পিএমএল-এন-নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। কিন্তু ছোট ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নওয়াজের পক্ষে কখনই সহজ+ ছিল না। কারণ সে সময়ও চতুর্থবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল।
 
এরপর ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে করে নওয়াজকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে হওয়া যত দুর্নীতির মামলা সব প্রত্যাহার করা হয়। রাজনীতি ও সরকারি পদে বসার ব্যাপারে ‌তাকে যে ‌’আজীবনের জন্য’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, দ্রুতই সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এ সময় সবার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, নওয়াজকে ক্ষমতায় বসাতে মরিয়া সামরিক বাহিনী‌।
 
অন্যদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দী ইমরান খানকে কারাগারে পাঠানো হয়। শুধু তাই নয়, তার দল পিটিআই’র নিবন্ধন বাতিল, দলের নির্বাচনী প্রতীক বাতিল ও নেতাকর্মীদের ওপর নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালিয়ে নওয়াজ ও তার দলকে জেতানোর সব ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে ‘মিয়া ভাই’র প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ভোটের ফল ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত নানা সময় শাহবাজ শরিফও বলেছেন, দলের প্রধান নওয়াজ শরিফকে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান তিনি।
 
কিন্তু বহু কাঙিক্ষত সেই প্রধানমন্ত্রীত্ব পেয়েও কেন সরে দাঁড়ালেন নওয়াজ, তার ব্যাখা করতে গিয়ে পাকিস্তানি সাংবাদিক রিজওয়ান শেহজাদ বলেন, ‘নির্বাচনী রায়ের বিভক্তি, শেষ মুহূর্তে তার ভাই শেহবাজের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে নতুন একটি রাজনৈতিক ভূমিকায় দেখা ছাড়া বিকল্প কিছু খুঁজে পাননি নওয়াজ।’
 
নওয়াজের নিজের অবস্থান কেমন, এমন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কার কন্যা মরিয়মো। তিনি বলেছেন, নওয়াজ দলের ‘নির্বাচক’ বা ‘মনোনয়নকারীর’ ভূমিকায় থাকবেন যিনি পর্দার আড়াল থেকে ভূমিকা রাখবেন।
 
এদিকে ইমরান খানেরও বয়স হয়েছে। ৭২ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন বরাবরই তার দলে তরুণ নেতৃত্ব অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচিত পিটিআই’র প্রার্থীদের দিকে তাকালেই বিষয়টি সহজেই স্পষ্ট হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পিটিআই’র নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেও অন্যতম প্রধান দুই দল পিএমএল-এন ও পিপিপিতে পরিবারতন্ত্রই থেকে যাচ্ছে।
 
নওয়াজ যেমন কন্যা মরিয়মকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার সব বন্দ্যোবস্ত করছেন, একইভাবে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও পিপিপির কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারিও ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে নিয়েও উচ্চাভিলাস রয়েছে।
তাই ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রাজনীতে মূল খেলোয়াড় হতে যাচ্ছে মরিয়ম, বিলাওয়ালের মতো তরুণরা। এই নির্বাচনেই বিভিন্ন বক্তব্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে সেটির প্রমাণ দিয়েছেন তারা।