রূপক দত্ত চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধিঃ
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার উত্তর উত্তরসুর হাইল হাওরে এলাকায় শ্রীমঙ্গলের মেয়ে কাজী আয়েশার শখের বশে গড়ে তোলা কাজী এন্ড আজাদ এগ্রো ফার্ম এখন বিভাগের সমন্বিত আদর্শ কৃষি খামার। প্রবাসে থেকেও শ্রীমঙ্গলের মেয়ে কাজী আয়েশা শখের বশে গড়ে তোলেছেন সমন্বিত এ আদর্শ কৃষি খামার।
খামারের নিরাপত্তায় রয়েছে চারদিকে হাইরেজুলেশনযুক্ত নাইট ভিশন সিসি ক্যামেরা। খামারের মাঝখানে শীসা মহল নামে দু'তলা বিশিষ্ট নান্দনিক অতিথি শালা। খামারটি রাতের আধাঁরে আলোর ঝলকানিতে দূর থেকে রাজমহল মনে হবে।
কাজী আয়েশা মনি ও স্বামী কাজী জয়নাল আবদীন সহযোগিতায় শখের বশে গড়ে তোলেছেন সমন্বিত এ আদর্শ কৃষি খামার। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে তিনি বিদেশ থেকে দেখাশুনা করেন। বছরে দু'য়েকবার খামারটি দেখতে আসেন। খামারের শুরুতেই চোখে পড়ে বাগানে সারি সারি আম গাছ। গাছে ঝুলে আছে ১২ মাসি নানা জাতের আম। বিভিন্ন জাতের আমে ভিন্ন ভিন্ন রং রয়েছে। চায়না কিংআফ চাকপাত আমের রং লাল, হলুদ রঙের ল্যাংড়া আমে দৃষ্টিনন্দন হয়ে আছে ।
শখের বাগানে ২৬ প্রজাতির ৪ হাজার ৫০০টি বিদেশি ও ৪০ প্রজাতির ৪৫০টি দেশীয় ফলজ ও বনজও গাছ রয়েছে। এছাড়া আছে ক্যান্সার প্রতিরোধক ‘করোসল’ ফল ।
শখের বসে গড়ে তোলা সমন্বিত এ কৃষি খামারটি হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময়। দুই বছর পূর্বে প্রায় সাত একর জমিতে কাজী অ্যান্ড আজাদ এগ্রো ফার্ম নামে কৃষি খামারটি গড়ে তোলেন । এখন তা বেড়ে ২৫ একর জমিতে রূপ নিয়েছে। শখের সমন্বিত কৃষি খামারে গাছে গাছে ঝুলছে বিদেশি জাতের বারমাসি আম।
ব্যানানা ম্যাংগো, কিউজার, ডকমাই, কিং অফ চাকাপাত থাইল্যান্ড ও বারমাসি আম। রয়েছে দেশি জাতের বারি-১১ , বারি-৪, আম্ররুপালি
ল্যাংড়া, হাঁড়িভাঙা জাতের আমসহ প্রায় ১হাজারেরও বেশি আম। রয়েছে বল সুন্দরী কুল বড়ই, ছোট মিষ্টি ও টক বড়, ই-গোল্ডেন ৮ পেয়ারা। খামারে অর্গানিক পদ্ধতিতে ফল ও সবজির চাষবাদ করা হয় । খামারে ২০২২ সালে প্রথম বছর ৭ মণ আম ফলন হয় । গত বছর ২০২৩ সালে আমের ফলন ৪০ মন হয়েছে । সমন্বিত এ খামারে এছাড়াও রয়েছে ২৬ প্রজাতির ৪ হাজার ৫০০টি বিদেশি ফলজ ও বনজও গাছ। এই শখের বাগানে রয়েছে রেড আইবেরি, ইন্ডিয়ান আলপানস, অমেরিকান পালমার, অগ্নিশ্বর কলা, চাইনিজ কমলা, থাই জামবুরা, দার্জিলিং কমলা, চায়না-৩ লিচু,বুম্বাই লিচু, ছফেদা, আনার, একোকেডু,সাউথ আফ্রিকান হলুদ মাল্টা, চায়না টক কুল, থাই বার মাসি মালটা,থাই কাডিমুন বারমাসি, থাই পিংক কাঁঠাল, থাই বারমাসি কাঁঠাল, থাই লংগান, রামভুটান, জি নাইন কলা, অগ্নিশ্বর কলা, পেঁপে,কামরাঙা, মিষ্টি তেঁতুল ও ভীয়েতনামের ছোট নারিকেল আরও চাষ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের শাস সবজি। পাম্প পানির লাইনের মাধ্যমে এসব গাছে পানি দেওয়া হয়।
পুকুরের পাড় ধরে মাঁচার উপর শোভা পাচ্ছে চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লাউ। নিচে সারিবেঁধে কাঁচামরিচ বেগুন, ফুলকপি,বাঁধাকপি লাল ফুলকপি, পুইশাক, টমেটো, করলা,টমেটো, বোম্বে মরিচসহ নানা জাতের শাক সবজি। খামারের মাঝে রয়েছে দেশীয় বিভিন্ন জাতের মাছের চাষ। রয়েছে গরু ও দেশীয় মুরগী,ছাগল ও ভেড়ার খামার। ধানের মৌসুমে বুরো,আমন ও আউশ ধানের চাষ করা হয়।
আদর্শ খামার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাজী আয়েশা মনি বলেন , আমি প্রবাসে বসবাস করি।সেখানে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মাতৃভূমি শ্রীমঙ্গলে কিছু করতে চেয়েছিলাম। ছোট বেলা থেকে আমার কৃষির প্রতি দুর্বলতা ছিল। আমার স্বামী মো: জয়নাল আবদীনের সহযোগিতায় শ্রীমঙ্গলের হাওরে জায়গা কিনে খামারের কাজ শুরু করি। পরবর্তিতে আরও কিছু জায়গা ক্রয় করে খামারের জায়গা বৃদ্ধি করি। ধীরেধীরে খামার থেকে আশানুরূপ ফলন পাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, লন্ডনের রেড আপেল, পেয়ারস , চেরি ফল এনে লাগানো হয়েছে ফার্মে। কালেংশন করে কালো চেরি টমেটো, ব্রকলি, রেড কেবিজ লাল আনারস লাগিয়েছি। ভারত থেকে গঙ্গাবর্ধন নারকেল গাছ, কেরালা নারিকেলসহ বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ সংগ্রহ করেছি।
চাইলে আপনিও এমন খামার গড়তে পারেন। এজন্য গাছ লাগানো ও এর পরিচর্যা কিভাবে করতে হয় তা ইউটিউব চ্যানেল kazi & azad agro farm চ্যানেলে সবকিছুর আপডেট দেয়া রয়েছে। চাইলে যে কেউ অনুসরণ করে নিজের মতো করে এমন উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেন। আমার এ ফার্ম দেখে এখন পর্যন্ত তিনজন
পরামর্শ নিয়ে এ ধরনের চাষাবাদ করছেন।
সিলেট অঞ্চলের এখনও অনেক জায়গা অনাবাদি বা পতিত জমি রয়েছে। এসব জমি ফেলে না রেখে কৃষি কাজে লাগানো প্রয়োজন। ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় এর পরিধি বাড়ানো অনেক অপেক্ষা করতে হয়। সরকারি সহযোগিতা পেলে ও খাঁস জায়গা পেলে আমি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে এধরনের আরোও বড় উদ্যোগ নিতে পারবো। এতে দেশের উপকার হবে ও এ উপজেলার বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: মহি উদ্দিন বলেন, এই খামারটি একটি সমন্বিত কৃষি খামার। এই খামারটিতে ৪০ ধরনের বিভিন্ন জাতে আম রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কোন জমি অনাবাদি জমি এক ইঞ্চিও জমি খালি রাখা যাবে না। সেই অনাবাদি জমিকে খামারে আবাদের পর্যায়ে আনা খামারটি একটি অসাধারণ উদাহরণ। এই খামারটিতে আমরা নিয়মিত সারের ড্রোজ, কিভাবে করলে লাভ জনক হবে ইত্যাদি পরামর্শ প্রদান করে আসছি।
এখানে বিভিন্ন ভেরাইটি আমআছে। এই আম, মাল্টার ভেরাইটি যদি সিলেট অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে দেখবেন প্রচুর জমি আবাদের আওতায় চলে আসবে। খামারটি পুরোপরি সিসি ক্যামেরার আওতাধীন করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য কুকুর রয়েছে, যেভাবে করলে একটি খামারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শতভাগ থাকে এই খামারটিতে সম্পূর্ণ সেভাবেই ব্যবস্থা আছে। সিলেট বিভাগে এটি একটি আদর্শ কৃষি খামার হিসেবে গড়ে উঠছে। সামনে এই খামারির মাধ্যমে আরোও কৃষক ও কৃষানি উদ্বুদ্ধ হবে। আমরা খামারির উত্তর উত্তর সাফল্য কামনা করছি।
বিদেশে থেকে দেশে বিনিয়োগ করে কিভাবে লাভবান হওয়া যায় তার অনন্য উদাহরণ কাজী এন্ড আজাদ এগ্রোফার্ম ।
আমরা সবজি বাগান, ফল বাগানের পরিচর্যার নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে থাকি। সার কীটনাশক জনিত সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে আমাদের সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ মাঠে গিয়ে করণীয় সবধরনে পরামর্শ প্রদান করেন। এছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প ও ফিপ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের ফল বাগান স্থাপন করি। কৃষি অফিস থেকে আগামী বর্ষাকালে কাজী এন্ড আজাদ এগ্রো ফার্মকে বিভিন্ন গাছের চারা কলম দেওয়া হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা কর্ণ চন্দ্র মল্লিক বলেন, শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত সমন্বিত একটি এগ্রো:। এখানে গবাদিপশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন কৃষিজ ফলের চাষাবাদ করা হয়। এই খামার টি শ্রীমঙ্গলে প্রথম স্মার্ট খামার। স্মার্ট বাংলাদেশের খামার হিসেবে মনে করি। সুদূর লন্ডন থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। উপজেলা প্রাণীসম্পদ এন্ড ভেটেনারি হসপিটাল শ্রীমঙ্গল সব সময় এরকম একটি খামার গড়ে তোলায় স্বাদুবাদ জানাই। আমরা কাজী এন্ড আজাদ এগ্রো: ফার্ম লিমিটেড মনিটরিং করে থাকি। ভেকসিনেশন থেকে শুরু করে আমরা মেডিক্যাশন সবকিছু আমরা রুটিন চেকআপ করে থাকি।
এই খামারটির প্রতিষ্ঠাতা কাজী আয়েশা উনি একজন উদ্যোক্তা। আমার মনে হয় এরকম একজন উদ্যোক্তা যদি আরোও শ্রীমঙ্গল তথা বাংলাদেশে আর বেশি পরিমাণে হয় তাহলে দেশে যে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যে বেকার যুবক আছে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।