হজের প্রস্তুতি শুরু হোক এখন থেকেই

 

 

এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব।

 

হজ ইসলামের ৫ম রোকন বা স্তম্ভ। হজ অর্থ সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা। হজ মুসলমানদের মধ্যে শুধু ধনীদের ওপর জীবনে একবার ফরজ। অর্থাৎ কেবল যাদের সামর্থ্য আছে তাদের জন্য এ আদেশ। হজ হলো পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত কাবা ঘর তাওয়াফ করা ও আনুষঙ্গিক কার্য সম্পাদন করা। আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেন:-এবং মানুষের নিকট ঘোষণা করিয়া দাও, উহারা তোমার নিকট আসিবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটগুলোর পিঠে, ইহারা আসিবে দূরদূরান্ত পথ অতিক্রম করিয়া (সূরা হজ-২৭)। অতঃপর তাহারা যেন তাহাদিগের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাহাদিগের মানত পূর্ণ করে এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের (সূরা হজ-২৯)।

 

এখানে প্রাচীন গৃহ বলতে পবিত্র কাবা ঘরকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আদম (আ.)কে দুনিয়াতে পাঠানোর পর তিনি আল্লাহর নিকট ইবাদতের জন্য একটি স্থান ও গৃহের আবেদন করলে আল্লাহ জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে ওই স্থান নির্ধারণ করে একটি গৃহ নির্মাণের আদেশ দেন। আর ইহাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও প্রাচীন গৃহ নামে খ্যাত। প্রমাণ স্বরূপ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:-নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম যে ঘর মানুষের জন্য স্থাপিত হইয়াছিল, তা তো সেই ঘর যাহা মক্কায় অবস্থিত যা বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত। এতে রয়েছে অনেক প্রকাশ্য নিদর্শন। মাকামে ইবরাহিম তার অন্যতম। যে কেউ এ ঘরে প্রবেশ করে সে নিরাপদ হয়ে যায়। আল্লাহর জন্য উক্ত ঘরের হজ করা লোকদের ওপর ফরজ। যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে এবং যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে সে জেনে রাখুক নিঃসন্দেহে আল্লাহ দুনিয়ার কাহার মুখাপেক্ষী নহেন (সূরা আলে-এমরান-৯৭,৯৮)।

 

হাদিসে রাসূল (সা.) থেকে জানা যায়-হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হইতে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ইমান আনা। জিজ্ঞেস করা হলো তারপর কোনটি? তিনি বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো তারপর কোনটি? তিনি বললেন হজ-ই মাবরুর (মকবুল হজ) করা (বোখারি-১৪২৯)। উম্মুল মোমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) জেহাদকে আমরা সর্বোত্তম মনে করি, কাজেই আমরা কি জিহাদ করব না? রাসূলূল্লাহ (সা.) বললেন না, তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আমল হলো ‘হজে মাবরুর’ (বোখারি-১৪৩০)।

 

আল্লাহ ঘোষণা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করিয়াছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করিবে নিরাপদে। কেহ কেহ মাথা মুণ্ডন করিবে, কেহ কেহ কেশ কর্তন করিবে। তোমাদিগের কোনো ভয় থাকিবে না। আল্লাহ জানেন তোমরা যাহা জান না। ইহা ছাড়া তিনি তোমাদিগকে দিয়েছেন এক সদ্য বিজয় (সূরা-ফাতহ-২৭)। এ আয়াতটি একাধারে মক্কা বিজয় ও হজ সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। আল্লাহ আরও বলেন-এসব চতুষ্পদ জন্তুতে তোমাদিগের জন্য নানাবিধ উপকার রহিয়াছে এক নির্দিষ্ট কালের জন্য, অতঃপর উহাদিগের কোরবানির স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট (সূরা হজ-৩৩)।

 

হজের প্রকারভেদ

 

হজকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-১) হজে ইফরাদ ২) হজে কিরান ৩) হজে তামাত্তু।

 

হজে ইফরাদ

 

যে হজ ব্যবস্থায় ওমরা ব্যতীত শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধতে হয়, তাহাকে হজে ইফরাদ বলে। বদলি হজও এ হজের আওতাভুক্ত। ইফরাদ হজ পালনকারীর জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব নয়।

 

হজে কিরান

 

একই ইহরামে ওমরা ও হজ একত্রে আদায় করাকে হজে কিরান বলা হয়। এ অবস্থায় মাথা মুণ্ডানো যাবে না। তবে ইহরাম অবস্থায় সম্পূর্ণ হজ সম্পাদন করতে হবে।

 

হজে তামাত্তু

 

তামাত্তু হজে প্রথমে ওমরা পালন করে মাথা মুণ্ডন করিবে। পরে নতুন করে ইহরাম বেঁধে নতুন করে মূল হজ সম্পন্ন করতে হবে।

 

হজ ও ওমরার মিকাত

 

যায়েদ ইবনে যুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর কাছে তার অবস্থান স্থলে যান, তখন তার জন্য তাঁবু ও চাদর টানানো হয়েছিল। যায়েদ (রা.) বলেন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন স্থান থেকে ওমরার ইহরাম বাঁধা জায়েজ হবে? তিনি বলেন রাসূল (সা.) নজদবাসীর জন্য কারনুল, মদিনাবাসীর জন্য যুল-হুলাইফা ও সিরিয়াবাসীর জন্য যুহফা নির্ধারণ করে দিয়েছেন (বুখারি-১৪৩২)। (বর্তমানে হাজিদের সংখ্যা ও বিভিন্ন দেশ থেকে আগমন অনুযায়ী ভিন্নতা রয়েছে)। বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ থেকে যারা হজে গমন করেন তাদের অনেকেই রওনা হয়েই বাংলাদেশেই ইহরাম বেঁধে ফেলেন। এতে যারা প্রথমে মদিনায় যাবেন তাদের জন্য ঠিক নয়। আর যারা মক্কায় যাবেন তারা অবশ্যই ওমরা না করে ইহরাম খুলতে পারবেন না। তাহলে কাফ্ফারা দিতে হবে।

 

হজের ফরজ

 

১) ইহরাম বাঁধা ২) ৯ জিলহজ হতে পরদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার মাঠে অবস্থান করা। ৩) কাবা ঘর তাওয়াফ করা।

 

হজের ওয়াজিব

 

১) সাফা-মারওয়া সায়ী করা। (এটি মা হাজেরা (আ.) পানির জন্য করেছিলেন)। ২) ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ে আরাফা থেকে মুজদালিফায় আগমন ও অবস্থান করা (যা উকুফ)। ৩) ১০,১১,১২ তারিখে শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করা (যা হজরত ইসমাইল (আ.) করেছিলেন)। ৪) ১০ থেকে ১২ জিলহজ মিনা ও হারাম এলাকায় কুরবানি করা। ৫) কুরবানির পর মাথা মুণ্ডানো। ৬) কাবা ঘর বিদায়ী তাওয়াফ করা।

 

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ

 

পুরুষের মাথা ও মহিলার মুখ ঢাকা নিষেধ। সেলাই করা পোশাক পরা, আতর, সেন্ট, সুগন্ধি, খুশবু, তৈল, সাবান ইত্যাদি ব্যবহার করা নিষেধ। চুল, দাড়ি, গোঁপ, নখ কাটা ও চিরুনি ব্যবহার করা নিষেধ। চুল দাড়িতে হেজাব বা কলপ লাগানো নিষেধ। শরীর থেকে ময়লা সরানো, উকুন, পোকামাকড়, মশা-মাছি ইত্যাদি মারা নিষেধ। তবে ক্ষতিকর সাপ, বিচ্ছু মারা যাবে। ঘাস, পাতা ইত্যাদি ছিঁড়া বা নিধন করা নিষেধ। বিবাহ করা বা দেওয়া, স্বামী-স্ত্রীর মিলন নিষিদ্ধ। কাহারও সমালোচনা করা, গিবত করা, হাসি-ঠাট্টা বা বিদ্রুপ করা, চুরি করা, প্রতারণা করা ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষেধ। এমনকি ইহরাম অবস্থায় ক্রয়-বিক্রয় করাও নিষিদ্ধ।

 

হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করল এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত রইল সে নবজাতক শিশু যাকে তার মা এইমাত্র প্রসব করেছে, তার ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে (বুখারি-১৪৩১)। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা এখানে একত্রিত হবে, পরিচিতি ও ভাব বিনিময় হবে, ঐক্যবদ্ধ হবে, ইসলামের প্রচার প্রসার হবে। সারা বিশ্বের অমুসলিমরা তা প্রত্যক্ষ করবে। মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি হবে। পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। এটাও হজের একটা মূল শিক্ষা।

 

লেখক:

এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব।

প্রতিষ্ঠাতা-কুমিল্লা জিলা মাদরাসা।

খতিব,প্রাবন্ধিক ও টিভি উপস্থাপক।