ছাত্রনেতা থেকে হাসপাতালের দালালচক্রের নেতা!

স্টাফ রিপোর্ট রাজিব হাওলাদার:    ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দালালচক্রের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রোগী ভাগিয়ে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানোর গল্প মোটামুটি সবারই জানা।

সম্প্রতি দৈনিক বাংলার অনুসন্ধানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) থেকে এভাবে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার পাঁচটি দালাল চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চার ছাত্রনেতা।

জানা গেছে ঢামেক থেকে বেসরকারি হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি করাতে পারলে প্রতি রোগীর বিপরীতে পাওয়া যায় একটা পার্সেন্টেজ। সেই রোগীর কত বিল হয় সেটির ওপর নির্ভর করে পার্সেন্টেজের পরিমাণ। ক্ষেত্রবিশেষে এই পার্সেন্টেজের পরিমাণ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। কোথাও কোথাও রোগী যতদিন ভর্তি থাকবে সে হিসাবে দিনপ্রতিও কমিশন নেওয়ার সুযোগ আছে। দালালচক্রের সদস্যের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কখনো কখনো রোগী যেতে রাজি না হলে তাদেরকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি তাদের মারধরও করা হয়ে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আনসারের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) মো. উজ্জ্বল বেপারী এবং ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া চক্রগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়েও মাসোহারা পান। তবে তারা উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা যেসব রোগীর এনআইসিউ বা আইসিউ প্রয়োজন হয় সেসব রোগীকে টার্গেট করেই এই পাঁচটি চক্র কাজ করে। এ ছাড়া মাঝেমাঝে সাধারণ রোগীরাও তাদের টার্গেটের শিকার হয়।

হাসপাতালের ভিতর বিভিন্ন দেয়ালে ‘দালাল দেখলে ধরিয়ে দিন’ শীর্ষক যেসব স্টিলের প্লেট লাগানো হয়েছে সেখানে থাকা যোগাযোগের নম্বরগুলোও কালো কালি দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। এতে এসব চক্রের সদস্যরা অনেকটা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে।

পাঁচ চক্রের নেতৃত্বে যারা

জানা গেছে, পাঁচটি চক্রের মধ্যে তিনটি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা, তারা একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় শেখ স্বাধীন সাবিত এবং ইয়ামিন রহমান শুভ। এর মধ্যে শেখ স্বাধীন সাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় হেদায়েত উল্লাহ সরকার এবং কাজী রাশেদ। এর মধ্যে হেদায়েত শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। আর রাশেদ একই হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-সম্পাদক। অন্য এক গ্রুপের নেতা ইমরান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি।

বাকি দুই গ্রুপের নেতৃত্বে যারা আছে, তারা হলো হান্নান এবং কাশেম। এর মধ্যে কাশেম ট্যাক্সি কাশেম নামে হাসপাতাল এলাকায় পরিচিত।

এদের মধ্যে কোন গ্রুপ কোথায় কাজ করবে তা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। সাবিত-শুভ এবং হেদায়েত-রাশেদ গ্রুপটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হাসপাতালের ২১১ এবং ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে। এই দুটি এনআইসিউ এবং গাইনি ওয়ার্ড। সার্বক্ষণিকই এই দুই ওয়ার্ডের সামনে চক্রের সদস্যদের অবস্থান থাকে। এই দুই ওয়ার্ডে বাকি তিন গ্রুপের কেউ কাজ করতে পারে না। এই দুটি গ্রুপসহ বাকি তিন গ্রুপ কাজ করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। তারা সবাই কাজ করে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। দিনের বেলা তাদের কাজ বন্ধ থাকে।

যে গ্রুপ যেসব হাসপাতালে রোগী পাঠায়

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ স্বাধীন সাবিত এবং ইয়ামিন রহমান শুভর নেতৃত্বে থাকা গ্রুপটি মেডিফেয়ার জেনারেল হাসপাতাল, ইউনিহেলথ, আহমেদ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, প্রাইম এবং ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতালে রোগী পাঠায়। এই গ্রুপের ছয় সদস্যের নাম জানা গেছে। তারা হলেন জুয়েল, নিপু, মেহেদী, টুটুল, আল আমিন এবং এস এম খলীল। এই সদস্যরা মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনে সাবিত-শুভর হয়ে কাজ করে থাকে।

হেদায়েত এবং রাশেদ একটি গ্রুপ মেডিফেয়ার, সুপার স্পেশালিস্ট, প্রাইম এবং ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতালে রোগী পাঠায়। এই দুই গ্রুপের হয়ে কাজ করে আলমগীর, রিপন, নাদিম, মিরাজ এবং হানিফ।

ইমরান খানের গ্রুপটি হসপিটাল টোয়েন্টি সেভেন এবং বাংলাদেশ ক্রিটিক্যাল কেয়ারে রোগী পাঠায়। এই গ্রুপের সদস্যরা হলেন ইব্রাহিম, নয়ন, নাফিস। তবে ইমরান তাদের মাসিক ভিত্তিতে বেতন দেয় না। রোগী ভিত্তিক টাকা দেয়। আর মাস শেষে প্রত্যেকের টাকার পরিমাণ ২০-২২ হাজারে পৌঁছায়।

ট্যাক্সি কাশেমের গ্রুপটি আমার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্রিটিক্যাল কেয়ার, প্রাইম এবং ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রোগী পাঠায়। আর এই গ্রুপের অধীনে কাজ করে এরকম দুইজনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা হলো মনির এবং বিল্লাল।

হান্নানের গ্রুপটি বিএনকে, এ ওয়ান, প্রাইম এবং হেলথ কেয়ারে রোগী পাঠায়। এই গ্রুপে কাজ করা সদস্যরা হলেন শরিফ, ইসমাইল, তুষার এবং অপু।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হান্নানের গ্রুপটি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ তুনানের নাম ব্যবহার করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। অভিযোগ রয়েছে, এসব হাসপাতালে তুনানও রোগী পাঠায়। সেসব রোগীর বিলের একটা পার্সেন্টেজ তুনানের পকেটে যায়।

চক্রের সদস্যদের হাসপাতালগুলোর মধ্যে মেডিফেয়ার অবস্থিত মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে, ইউনিহেলথ পান্থপথ সিগন্যালে, আহমেদ স্পেশালাইজড চানখাঁরপুলে, প্রাইম এবং ঢাকা হেলথ কেয়ার অবস্থিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিপরীত পাশের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের দুই এবং তিন তলায়। সুপার স্পেশালিস্ট, হসপিটাল টুয়েন্টি সেভেন এবং বাংলাদেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ার অবস্থিত ধানমন্ডি ২৭-এ। বিএনকে হাসপাতাল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পাশে। আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল অবস্থিত শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডের পাশে।

এই প্রতিনিধি ছদ্মবেশে দালালচক্রের সদস্য সেজে হাসপাতালগুলোর সঙ্গে কথা বললে তারাও জানায়, চক্রের নেতাদের নামে তাদের হাসপাতালে কোড আছে। এসব কোডের অধীনে তারা সেখানে রোগী পাঠায় এবং রোগীভেদে তারা প্যাকেজ বা রোগী হাসপাতালে যতদিন থাকবে এর প্রতিদিন হিসাবে টাকা পায়।

দালালের ছদ্মবেশে এওয়ান হাসপাতালের পরিচালক সাইয়েদ ইসলাম সাইফের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, কোনো আইসিইউ রোগী এনে দিতে পারলে রোগী ভর্তি হওয়ার পরপরই আপনি ১৮ হাজার টাকা পেয়ে যাবেন। এটা হলো প্যাকেজ সিস্টেম। আর পার ডে হিসাবে নিলে দৈনিক পাবেন ৫ হাজার টাকা।

পরিচয় গোপন রেখে চক্রের কয়েকজন নেতাকে ফোন দিলে তারাও এই প্রতিবেদককে রোগী যতদিন ভর্তি থাকবে সে হিসাবে দিনপ্রতি ৪ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

দালাল চক্রের সদস্যরা যেভাবে কাজ করে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চক্রের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে যখনই কোনো রোগী আসে, চক্রের সদস্যরা তাদের অনুসরণ করে রোগীর স্বজন, হাসপাতালের ট্রলিম্যান বা যে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে আনা হয়েছে সেই অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সঙ্গে কথা বলে রোগীর রোগের ধরন জানার চেষ্টা করে। কথা বলে রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন হতে পারে এরকম কোনো সম্ভাবনা বুঝতে পারলে তারা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে থেকে তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এরপর তারা রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের রুম পর্যন্ত যায়। ডাক্তার যদি বলে রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন তখন থেকেই তাদের বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। এটিকে তাদের ভাষায় বলা হয় মার্কেটিং। তবে রোগীর অবস্থা যদি গুরুতর হয়, তখন ডাক্তারের রুম পর্যন্ত তারা রোগীকে নিতে দিতে চায় না। এর আগেই তারা রোগীর অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক কথা বলে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। যখনই কোনো রোগী তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে সম্মত হয়, তখনই চক্রের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ফোন দিয়ে রোগীর নাম এবং রোগীর পিতা বা মায়ের নাম জানিয়ে সেই রোগীকে তাদের চক্র প্রধানের নামে থাকা কোডে বুকিং দিতে বলা হয়। অনেক সময় এক রোগীর জন্য কয়েকটি চক্রের সদস্যরা একসঙ্গে ফোন দেয়। তখন যে চক্রের সদস্যরা আগে ফোন দেয় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয় ‘কল ক্লিয়ার’ আর যারা পরে ফোন দেয় তাদের বলা হয় ‘কল বুকড’।

আর যে দুটি চক্র মেডিকেলের ২১১ এবং ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করে তাদের সদস্যরা এসব ওয়ার্ডের সামনে প্রায় সময় অবস্থান করে। সেখানে থেকে তারা ফলো করে কোন রোগীর এনআইসিউ বা আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে। আইসিইউ বা এনআইসিইউ প্রয়োজন রোগীদের টার্গেট করে। অনেক সময় তারা যেসব রোগীর এসবের প্রয়োজন নেই, তাদেরও টার্গেট করে। তাদের বাচ্চার জন্য এনআইসিউ প্রয়োজন বা এনআইসিউতে না নিলে তাদের বাচ্চার সমস্যা হয়ে যাবে, এমন সব কথা বলে তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। এবং বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

চক্রের সদস্যরা রোগীদের তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বিভিন্ন প্রতারণা বিশেষ করে কম খরচে রোগীর চিকিৎসা করানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। আর চিকিৎসা শেষে বিলের কাগজ দেখে কপালে হাত দিতে হয় রোগীর স্বজনদের।

প্রতিবাদ করলে রোগীর স্বজনদেরও করা হয় মারধর

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট নেই এবং রোগীর জরুরি ভিত্তিতে এনআইসিউ প্রয়োজন দাবি করে দালাল চক্রের সদস্যরা এক রোগীকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় সেই রোগীর স্বজনদেরও মারধর করে সাবিত-শুভরা।

ঘটনার ভুক্তভোগী মোহাম্মদ রাসেল শান্ত বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আমার ভাতিজার জন্ম হয়। কিছুক্ষণ পর এক লোক এসে নিজেকে হাসপাতালের লোক দাবি করে বলেন, ‘আমাদের এখানে সিট নেই। আপনারা এখানে ভর্তি হতে পারবেন না। বাচ্চাকে সুস্থ রাখতে চাইলে এখান থেকে দ্রুত নিয়ে যান। পাশেই মেডিফেয়ার নামে একটা হাসপাতাল আছে। সেখানে সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জিজ্ঞেস করি, মেডিফেয়ারে নেওয়ার বিষয়টা ডাক্তার বলেছে কি না। তখন তিনি বলেন, হ্যাঁ। এরপর আমরা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে সে ডাক্তারের কাছে যেতে গড়িমসি করছিল। তখন আমরা বুঝতে পারি সে দালাল। এরপর ওই লোকটাকে আমরা ঢাকা মেডিকেলের পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসি। এ সময় সেখানে সাবিত ভাইও (স্বাধীন সাবিত) হাজির হয়। ছাত্রলীগ করার কারণে আমি উনাকে চিনি। এরপর ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু ভাই বিষয়টা ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে সমাধান করে দিয়েছে। সমাধান করার পর যখন আমরা ফাঁড়ি থেকে বের হই, তখন সাবিত ভাই তার লোকজনকে নিয়ে এসে আমাকে মারতে শুরু করে।

সেখানে তখন শাহবাগ থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক খালেকও উপস্থিত ছিলেন। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী যদি এই ঘটনায় মামলা করে, তাহলে আমরা অবশ্যই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করব।’

দালাল চক্রের খপ্পরে পড়া ভুক্তভোগীদের ভাষ্য

গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত আড়াইটার সময় দেখা যায়, একজন যুবক এক বাচ্চাকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে ছিল সাবিত-শুভ গ্রুপের সদস্য টুটুল। তাদের পিছু পিছু যাওয়ার পর দেখা যায়, তারা জরুরি বিভাগের গেট থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে সেই বাচ্চাকে চানখাঁরপুলের আহমেদ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করায়। পরে জানা যায়, সেই যুবকটির নাম হৃদয়। তিনি বাচ্চাটির বাবা। গত ১৫ জানুয়ারি তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঐ হাসপাতালে একদিন থাকার পর আমি বুঝেছি আমি দালালের খপ্পরে পড়েছি।’

২৬ ডিসেম্বর মধ্যরাতেই আহমেদ স্পেশালাইজড হাসপাতালেই দেখা মেলে আরেক রোগীর স্বজনের। সে সময় তিনি নেবুলাইজার লাগানো তার ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আহমেদ স্পেশালাইজড হাসপাতাল থেকে বের করে হেঁটে ঢাকা মেডিকেলের দিকে যাচ্ছেন। এ সময় তার গতিরোধ করে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় সাবিত-শুভ চক্রের সদস্য টুটুলকে।

এই রোগীর বাবা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘টুটুল নামের এই লোকটি এই হাসপাতলে ভালো ব্যবস্থা আছে বলে আমাদেরকে এখানে নিয়ে আসে। তার কথায় প্রভাবিত হয়ে আমরা চলে আসি। কিন্তু এসে দেখি, হাসপাতালের পর্যায়েও পড়ে না এটা। তাই আবার ঢাকা মেডিকেলেই চলে যাচ্ছি।’

যা বলছেন অভিযুক্তরা

সাবিত-শুভ গ্রুপের সদস্য টুটুলকে ফোন করলে তিনি সাবিতের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে ফোন কেটে দেন।

সব অভিযোগ অস্বীকার করে শেখ স্বাধীন সাবিত বলেন, ‘আমরা কোনো হাসপাতালের মার্কেটিং (দালালি) করি না। আমি মেডিফেয়ার হাসপাতালের মালিক। আমার এখানে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী আসে। আর ঢাকা মেডিকেলে আমরা যাই না। সেখানে আমাদের হয়ে কাজ করে এরকম কোন সদস্যও নেই।’

রোগীর স্বজন এবং অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে মারধরের ঘটনার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনার কাছে তথ্য থাকলে আপনি যা ইচ্ছা করেন। এটা নিয়ে আমার অত বেশি মাথাব্যথা নেই।’

এই গ্রুপের আরেক সদস্য ইয়ামিন শুভও অভিযোগ অস্বীকার করেন।

অন্য গ্রুপের নেতা হেদায়েত সরকার বলেন, প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে আমাদের প্রতিনিধি আছে। তারা বেতনভুক্ত। তারা সেসব হাসপাতালে আমাদের হয়ে মার্কেটিং করবে। তবে হাসপাতালের কোনো কর্মচারী বা অন্য কেউ রোগী পাঠালে তাদেরকে আমরা কমিশন দেই না। এসব কাজ করে মেডিফেয়ার বা আহমেদ স্পেশালাইজডের মতো হাসপাতালগুলো।

তবে এই গ্রুপের অন্য নেতা কাজী রাশেদ বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় বা অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের সাথে যোগাযোগ রাখি এটা সত্য। এদের মাধ্যমে যদি আমাদের হাসপাতালে কোনো রোগী আসে তাদেরকে আমরা পার-ডে ভিত্তিতে বা এককালীন একটা পার্সেন্টেজ দেই। এই টাকাটা পপুলার বা ল্যাবএইডের মতো হাসপাতালও দেয়। এখন এদের যদি আমরা টাকা না দেই তারা ত আমাদের রোগী দিবে না। তাই এই টাকাটা দিতে হয়। তবে আমরা নিজেদের কোন লোক হাসপাতালের ভিতরে রাখি না।’

তাহলে এই গ্রুপের সদস্য হানিফ, মিরাজ বা আলমগীর এরা কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরা আমাদের হাসপাতালের কর্মচারী। তাহলে তারা ঢাকা মেডিকেলে কী করে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।’

আরেকটি গ্রুপের নেতা ইমরান খান বলেন, ‘এই অভিযোগগুলো হাস্যকর। তবে এসব বিষয়ে সরাসরি কথা বলাই ভালো।’

অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে মারধর বা রোগীদের কনভিন্স করতে তাদের অ্যাম্বুলেন্সের সামনে উঠার চেষ্টার বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো কোনো কিছুই হয় না।

অন্য গ্রুপের নেতা হান্নান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এমনিতেই রোগী আসে। মার্কেটিংয়ের জন্য কেউ নেই। আর রোগী নিয়ে আসলে কাউকে টাকা দেওয়া হয় না।’

এই গ্রুপের শেখ তুনান রোগী পাঠিয়ে রোগীপ্রতি পার্সেন্টেজ পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনকে ছাড়া বাকি হাসপাতালগুলোর নামও আমি শুনিনি। আমার পেটে কোন হারাম টাকা নেই। আমার অনুরোধ আরেকটু ক্রচ-চেক করবেন।’

এরপর ছদ্মবেশে বিএনকে, প্রাইম এবং এ ওয়ান হাসপাতালে কথা বললে তারাও জানিয়েছেন, শেখ তুনানের নামে এখানে রোগী আসে এবং কোডও আছে। বিল নেওয়ার জন্য তিনি মাঝেমধ্যে সেসব হাসপাতালে যান। প্রাইম হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা ছবি দেখে তুনানকে শনাক্তও করেছেন।

অন্য গ্রুপের অভিযুক্ত নেতা ট্যাক্সি কাশেমের ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে না পারায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘দালালচক্রের ব্যাপারে আমরা অবহিত। আমরা তাদের উৎখাত করার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে তাদের দুইজন সদস্যকে আমরা গ্রেপ্তারও করেছি। এই চক্রের নেতারা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সেটাও আমরা অবহিত। এটি নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রক্টর মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করার চিন্তা করছি। স্যারদের আমরা অবহিত করেই এরপর এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী এসব কাজে জড়িত থাকা লজ্জার বিষয়।’

তিনি বলেন, হাসপাতালের আনসার, পুলিশ এবং ওয়ার্ড মাস্টারদের ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন ল্যাবরেটরি বা বেসরকারি হাসপাতালের কোনো লোক যদি আমাদের হাসপাতালে আসে তাদের ধরে যেন পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।

পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এবং আনসার প্লাটুনের কমান্ডারের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের বিষয়ে ঢামেকের এই পরিচালক বলেন, ‘এই বিষয়টাও শুনেছি।’ যেহেতু তারা সরকারি কর্মকর্তা তাই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কিছুটা কঠিন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো ‘দালাল দেখলে ধরিয়ে দিন’ শীর্ষক প্লেটে থাকা নম্বর মুছে ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবেমাত্র দুই সপ্তাহ হয়েছে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। তাই বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবহিত নই। আমি দেখব এটি।’