নিরাপদ ও আধুনিক সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং দেশের আর্থ সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) কাজ শুরু করলেও, এখনও তা পুরোপুরি আশার মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বহরে প্রায় ১৮০০ বাস আছে। এরমধ্যে বর্তমানে সচল রয়েছে ১ হাজারের মতো। আর বাকি ৬০০ বাস পড়ে রয়েছে বিভিন্ন ডিপোতে, যার অধিকাংশই অকেজো। সচল বাসের মধ্যে প্রায় ৪৫০টি ভাড়ায় ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন অফিসের স্টাফ এবং বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়ার কাজে। সিটি সার্ভিসের পাশাপাশি দেশের ১৬৩টি রুটে ৪২০টি বিআরটিসি বাস চলাচল করছে।
বিআরটিসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, মোট বাস ডিপো ২১টি। ট্রাক ডিপো ২টি। মোট বাস সংখ্যা ১৮৩০টি। এরমধ্যে নতুন বাস ৬০০টি এবং পুরানো ১২৩০টি। চলমান আছে ১১৮২টি। নিবন্ধনের অপেক্ষায় নতুন বাস ৩২৫টি। বিইআর বা বিয়ন্ড ইকনমিক্যাল রিপেয়ার ২৪৮টি। হালকা ও ভারী মেরামতের অপেক্ষায় আছে ৭৫টি বাস।
ঢাকা মহানগরীতে চলমান বিআরটিসি বাসের সংখ্যা ৭২৩টি; যার মধ্যে গণপরিবহন ৪৬৩টি, স্টাফ বাস ২৩৫টি, স্কুল বাস ৮টি এবং মহিলা বাস ১৭টি। ঢাকার বাইরে চলে ৩৬৩টি বাস, এগুলোর মধ্যে গণপরিবহন ৩০২টি, স্টাফ বাস ৫৮টি এবং মহিলা বাস ৩টি, লীজে পরিচালিত হয় ৯৬টি। ঢাকা মহানগরীতে চলমান রুট ২৮ এবং ঢাকার বাইরে চলমান রুট ১৩৪।
বিআরটিসি বলছে, সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের অফিসে যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৬৪টি রুটে তাদের ২০২টি স্টাফ বাস হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৮১টি বাস নিয়মিত চলাচল করছে।
এদিকে রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল ও মোহাম্মদপুরে চক্রাকার বাস সার্ভিসের আওতায় চলছে ৭টি বাস। বাংলাদেশ-ভারত সরাসরি বাস সার্ভিসের আওতায় ৫টি বাস চলাচল করছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নারীদের জন্য বিআরটিসির ৯টি বিশেষ বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের স্বল্প ভাড়ায় ও নিরাপদে যাতায়াতের সুবিধার্থে ঢাকায় শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল রুটে একটি বাস ও চট্টগ্রাম শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য কম ভাড়ায় ও নিরাপদে যাতায়াতের জন্য ১০টি বিআরটিসি বাস স্টুডেন্ট সার্ভিস হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
সচল ও অকেজো বাসের সংখ্যা
বিআরটিসির তথ্য বলছে, মতিঝিল বাস ডিপোতে ২০৪টি বাসের মধ্যে সচল ১২৭টি। কল্যাণপুর বাস ডিপোতে গাড়ির সংখ্যা ২১৪টি, তার মধ্যে সচল বাস ১৪১টি। বড় ধরনের মেরামতে আছে তিনটি। বিয়ন্ড ইকোনমিক্যাল রিপেয়ার বা বিইআর-এর আওতায় অকেজো বাস আছে ৫০টি।
বিআরটিসি বিভিন্ন মেয়াদে গাড়ি লিজ দেয়। যে কেউ তাদের কাছ থেকে লিজ নিতে পারেন। পাঁচ বছর থেকে ১০ বছর মেয়াদি লিজ দেয়। সংস্থাটি জানায়, লং লিজে পরিচালিত ২০টি বাসের মধ্যে ৩টি বাস ব্যক্তিমালিকানায় চলাচল করছে। বাকি ১৭টি বাস ডিপোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে গাবতলী বাস ডিপোতে মোট গাড়ির সংখ্যা ৬৪টি, এরমধ্যে সচল বাস ৬৩টি। মিরপুর বাস ডিপোতে গাড়ির সংখ্যা ১৪২টি। তার মধ্যে সচল ১২২টি। মোহাম্মদপুর বাস ডিপোতে ৩৩টি গাড়ি রয়েছে। সবগুলোই সচল অবস্থায় আছে।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর মাঝে কয়েকটি বছর বাদ দিলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত নিয়মিত লোকসান গুনেছে রাষ্টায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিআরটিসির বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, গত ২২-২৩ অর্থবছরে বিআরটিসি লোকসান থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু যাত্রী সংকটে প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি?
এ বিষয়ে কথা হয় বিআরটিসির বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যাত্রী সংকট আগের তুলনায় অনেক কমেছে। আমরা নতুন নতুন গাড়ি সড়কে ছেড়েছি। পদ্মা সেতু চালুর পর রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার ২৩টি রুটে ৬০টি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। আস্তে আস্তে যাত্রীদের আস্থার জায়গা তৈরি করছে বিআরটিসি। আর এজন্যই এখন আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’
তাজুল ইসলাম বলেন, বিআরটিসির অচল গাড়িগুলো মেরামত করে বাসসংখ্যা ১২১০-এ উন্নীত করা হয়েছে। ৫০টি গাড়িতে ভিডিও ক্যামেরা সংযোজন করা হয়েছে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবার পাশাপাশি নগর পরিবহন, পর্যটক বাস সার্ভিস, মহিলা বাস সার্ভিস, স্কুল বাস সার্ভিস, বাণিজ্য মেলা, মেট্রোরেল শাটল বাস সার্ভিস, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শাটল বাস সার্ভিস ইত্যাদি নানামুখী সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিআরটিসি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমানে ২০৮টি স্থানীয় রুটে এবং ৫টি আর্ন্তজাতিক রুটে বিআরটিসির বাস সার্ভিস পরিচালিত হচ্ছে। যেকোনো সময়ের তুলনায় বিআরটিসির কারিগরি সক্ষমতা এখন অনেক বেশি। যার ফলে মাত্র দুই (০২) দিনের মধ্যে ছাদখোলা বাস তৈরি করে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নারী ফুটবল দলকে সংবর্ধনা দেয়া হয় যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
বিআরটিসির সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইনহাউজ প্রশিক্ষণ, দক্ষ চালক ও কারিগর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিআরটিসি অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০২২-২৩ সময়কালে ২৬,০৪৭ জনকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রত্যেক ডিপো/ইউনিটে অনলাইন সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে সব কার্যক্রম মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি, ওয়াইফাই সুবিধা, ই-টিকেটিং, ফ্লিট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার ব্যবহারের মধ্যদিয়ে উন্নত পরিবহন সেবা দেয়া হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে যাচ্ছে বিআরটিসি।
গত আড়াই বছরে বিআরটিসি ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ডিপোতে ভাঙা গাড়ি জঞ্জালমুক্ত করা, চালকদের গাড়ি চালানো অনীহা দূর করা, ট্রাকের আয় ও বাসের মুনাফা বৃদ্ধি, গাড়ির মেরামত খরচ কমানো, বিপুল টাকা ব্যয়ে যন্ত্রাংশ ভারত থেকে না এনে স্বল্প খরচে নিজস্ব ওয়ার্কশপে তৈরি, চাকরি শেষে কর্মীদের পেনশন গ্র্যাচুইটি প্রদানসহ বিভিন্ন অর্জন রয়েছে, বলেন তাজুল ইসলাম।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বিআরটিসির পর্ষদ গঠন ও কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়েছে। কল্যাণ তহবিল নীতিমালা ২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিআরটিসির ১০টি বাসে প্রাথমিকভাবে চালকদের জন্য ফ্যাটিগ সতর্কীকরণ ডিভাইস সংযোজন করা হয়। বিআরটিসিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান করার পাশাপাশি সেবার মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার ফলে আয় বেড়েছে, ব্যয় কমানো সম্ভব হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে চালক ও কন্ডাকটরদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হচ্ছে। ডিপোতে কর্মরত কর্মচারীদের নীতি-নৈতিকতা এবং মানোন্নয়ন বাড়াতে বিভিন্ন সময় শুদ্ধাচার বিষয়ক অনুষ্ঠান, কর্মসূচি ও সভার আয়োজন করা হচ্ছে। দৈনন্দিন হালকা মেরামতসহ ভারী মেরামতের অপেক্ষায় থাকা বাস মেরামত করে অনরুট করা হয়েছে।
সারা দেশে ২২টি বাস ডিপো, দুটি ট্রাক ডিপো, দুটি যানবাহন মেরামত কারখানা, চারটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও ১৯টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিআরটিসির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বিআরটিসির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
>ইলেকট্রিক ভেহিকলসহ নতুন মডেলের বাস বিআরটিসি বহরে সংযুক্ত করা।
>আধুনিক সুবিধাসম্বলিত অফিস ভবনসহ কর্মচারীদের আবাসিক ভবন নির্মাণ।
>সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ডিপো ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন সিস্টেম চালু করা।
>বাংলাবান্ধা ও সিরাজগঞ্জে নতুন ২টি বাস ডিপো এবং খুলনা ও বগুড়ায় ২টি ট্রাক ডিপো স্থাপন।
>বরিশাল-কলকাতা, চট্টগ্রাম-কলকাতা ও ঢাকা-গ্যাংটক (সিকিম)-দার্জিলিং, ঢাকা-নেপাল আন্তর্জাতিক বাস রুট চালু করা।
>সব পরিবহনের জন্য বিআরটিসি’কে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলা।
>ইলেকট্রিক ভেহিকল পরিচালনার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা।
>প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে বিআরটিসি’কে যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা।
>বিআরটিসির অর্গানোগ্রাম ও চাকরি প্রবিধানমালা মোতাবেক শূন্য পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান।
>বিআরটিসির সব ডিপো/ইউনিটে গাড়ি মেরামত করে সচল গাড়ি সংখ্যা বৃদ্ধি করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা।
>বিআরটিসির সব ডিপো/ইউনিটে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসার জন্য নিজস্ব মেডিক্যাল সেন্টার স্থাপন করা।
আসছে ইলেকট্রিক বাস
শিগগিরই নতুন আরও ১০০টি ডাবল ডেকার আনতে যাচ্ছে বিআরটিসি। ৩৮৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে এজন্য। এগুলো ইলেকট্রিক বাস এবং এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ সুবিধা থাকবে। সাতটি বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হবে বাসগুলোর জন্য। এ দিয়ে কার্বণ নিঃসরণ কমানোর নতুন যুগে প্রবেশ করবে বিআরটিসি।
আয়ুস্কাল ফুরানোর আগেই গাড়িগুলো যাতে মরণদশায় পতিত না হয়- তাই এখন একমাত্র আশা।