আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
বাংলাদেশের মানুষ প্রধানত নলকূপের পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বেশিরভাগ নলকূপের পানিতেই বিপজ্জনক মাত্রায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে। যা পান করার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে লাখ লাখ মানুষ। নতুন এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির হলেও মানুষ এই পানি পান করছে। ফলে চর্ম, মূত্রাশয় ও ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে এমন লাখ লাখ মানুষ এসব দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে।
গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. সেথ ফ্রিসবি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নরউইচ ইউনিভার্সিটির রসায়নের ইমেরিটাস অধ্যাপক। সম্প্রতি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের সময় তিনি বলেন, ‘পানীয় জল থেকে আর্সেনিক বিষক্রিয়া এখন একটি বাস্তব সমস্যা, তাত্ত্বিক কোনো অনুশীলন নয়।’ আর্সেনিক দূষণ সংকটের সূত্রপাত মূলত ১৯৭৯-এর দশকে। সেই সময় দূষিত পানির কারণে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ছিল।
শিশুমৃত্যু কমাতে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়সতা সংস্থা ও এনজিওগুলো গার্হস্থ্য ব্যবহার, ফসল সেচ ও মাছ চাষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য গভীর নলকূপ বসানোর বিশাল এক কর্মসূচীর গ্রহণ করে। নতুন কূপগুলো পানিবাহিত রোগের বিস্তার কমিয়ে শিশু মৃত্যুর হার অনেকটা কমিয়ে এনেছিল।
কিন্তু এরপর আর্সেনিকের বিষক্রিয়া পরিলক্ষিত হতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায়, এই বিষক্রিয়ার মূল উৎস নলকূপের পানি। এরপর দেশব্যাপী নলকূপের পানি পরীক্ষা করে দেখা যায়, পরীক্ষাকৃত নলকূপের ২৯ শতাংশের পানিতেই মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।
বাংলাদেশে পানীয় জল থেকে দীর্ঘস্থায়ী আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে ১৯৯৩ সালে। ফ্রিসবি বলেন, ‘আর্সেনিক প্রাকৃতিকভাবে ঘটছে এবং হিমালয় পর্বতাঞ্চল থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি ও পলি মাটির সাথে নেমে আসছে। সুতরাং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ইরাবতী ও মেকং নদীর অববাহিকা থেকে আসা সমস্ত পলি প্রাকৃতিকভাবে আর্সেনিকযুক্ত।’
‘মানুষ যখন ভূ-পৃষ্ঠের পানি পান করত তখন কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ ভূ-পৃষ্ঠের পানি বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সম্পর্শে আসে এবং এটি আর্সেনিককে অদ্রবণীয় করে তোলে এবং পানি থেকে সরে যায়। কিন্তু গভীর কূপের পানি বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সংস্পর্শে না আসায় কূপ থেকে উঠিয়েই পান করা সমস্যাজনক। যা বড় জনস্বাস্থ্য সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে,’ বলেন ফ্রিসবি।
এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে আর্সেনিক জমা হয়। এটি হাতের তালু এবং পায়ের তলায় ত্বক শক্ত ও খসখসে হওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অনুরূপ প্রক্রিয়া শরীরের ভেতরেও চলে এবং এতে ফুসফুস ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোতে জমা হয়, যা এক সময় ক্যানসার সৃষ্টি করে।
বিজ্ঞানীরা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এরপর তারা আর্সেনিক নিঃসরণের মাত্রা বোঝার জন্য পানিতে অক্সিজেনের ঘনত্ব, পিএইচ ও তাপমাত্রা পরীক্ষা করে দেখেছেন। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের পান করা পানির ৪৯ শতাংশের মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টিকারী আর্সেনিকের অনিরাপদ মাত্রার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, পানিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ১০ পার্টস পার বিলিয়ন (পিপিবি)। কিন্তু বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ এলাকার নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ডব্লিউএইচও নির্দেশিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বলে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন। কিছু কিছু এলাকার পানিতে আর্সেনিকের ঘনত্ব প্রতি লিটারে ৪৫০ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মাত্রার চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি।
গবেষণা মতে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে লাখ লাখ মানুষ ক্যানসারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। ফ্রিসবি বলেন, ‘আমার হিসাবে বর্তমানে প্রায় ৭ কোটি ৮০ লাখ বাংলাদেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। আমি মনে করি, প্রায় ৯ লাখ বাংলাদেশি ফুসফুস ও মূত্রাশয়ের ক্যানসারে মারা যেতে পারে।’
২০১৮ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা তলিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমের তীব্র বৃষ্টিপাতের কারণে প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের প্রায় ২১ শতাংশ এলাকায় বন্যা হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পানিতে অতিরিক্ত মাত্রার আর্সেনিকের উপস্থিতির সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও মৌসুমী ভারী বন্যার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সমুদ্রের নোনা পানি সুপেয় পানির সাথে মিশে যাওয়ায় পলি থেকে আর্সেনিক নির্গত হয়।
Leave a Reply