আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের বয়স প্রায় দুই বছর হতে চললো। এই সময়েই মধ্যে দেশটির বহু এলাকা নিজেদের করে নিয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ। জবাবে ভলোদিমির জেলেনস্কির দেশ প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুর পরও তেমন বড় ধরনের কোন বিজয় অর্জন করতে পারেনি।
পরাক্রমশালী রাশিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো নিজস্ব কোন ক্ষমতাই নেই ইউক্রেনের। না আছে সেনা, না আছে অস্ত্রশস্ত্র। এতোদিন ভরসা ছিলো পশ্চিমাদের সহায়তা। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব শুরুতে হাত খুলে সহায়তা দিলেও এখন ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে দিচ্ছে।
একে প্রতিদিনের যুদ্ধ চালানোর ব্যয়, অন্যদিকে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির ফলে মারাত্মক চাপের মধ্যে আছেন ইউক্রেনের নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কি।
এরমধ্যেই ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দেখা দিয়েছে ঘনিষ্ঠ মিত্র জো বাইডেনের হাত গুটিয়ে নেয়া, আর কোন সহায়তা দেবে না আমেরিকার কর্তারা।
এসব কিছু ছাপিয়ে ইউক্রেনের জন্য আরও বড় সমস্যা দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে দেশটির সেনাদের মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যুদ্ধ এখন এক প্রকার অচলাবস্থায় আছে, রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে বলার মতো কোনো সফলতাই পাচ্ছে না কিয়েভ।
শ্যাম রাখি, না কুল রাখি অবস্থা জেলেনস্কির। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকতে আরও সেনার জন্য মরিয়া উঠেছেন তিনি। শুরুতে দেশপ্রেমের বাণী ছড়িয়ে সক্ষম নারী-পুরুষকে যুদ্ধের মাঠে নিয়ে আসতেও পারলেও এখন চিত্র বদলে গেছে। স্বেচ্ছায় আর কেউ যুদ্ধে যেতে চাইছে না।
কিয়েভ এতটাই মরিয়া যে, সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য রাস্তা থেকে পুরুষদের ধরে নিয়োগকেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে; মানুষের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হুমকি দিয়ে বা জোর করেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করানোর জন্য। বাড়ি বাড়ি গিয়ে যুবকদের খুঁজছে সেনাবাহিনীর লোকেরা।
যুদ্ধের জন্য সেনা জোগাড়ে যেন রীতমতো পাগলা কুকুর হয়ে গেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। অবস্থা এতোটাই বেগতিক যে, এক মানসিক প্রতিবন্ধীকেও সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতে চেষ্টা করেছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের আইনজীবী ও অধিকারকর্মীরা। এনিয়ে জেলেনস্কিকে একহাত নিয়েছেনও তারা।
নাগরিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়োগকেন্দ্রে যাওয়া হচ্ছে, এমন অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক সামাজিক ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। অনেককেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়োগ কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট করতে হচ্ছে।
পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়ে উঠেছে, যখন ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া ঠেকাতে অনেক ইউক্রেনীয়ই নাগরিক আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, রাশিয়ার অভিযান শুরু হবার পর থেকেই ইউক্রেনে জারি আছে সামরিক আইন। এ কারণে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নালিশ ধোপে টিকছে না।
পশ্চিম ইউক্রেনের আইনজীবী তেতিয়ানা ফেফচাক বলেন, সেনাবাহিনী নিজেদের দায়মুক্ত মনে করছে। তার মতে, যুদ্ধের জন্য সেনা ভর্তি করানোর কিছু কৌশল ইউক্রেনের আইন ভঙ্গ করেছে। কিয়েভের আরেক আইনজীবী জানান, তার স্বামী রাতে কাজ শেষে সকালে বাড়ি ফেরার সময় সেনা ধরে নিয়ে যায়।
৩৪ বছরের দিমিত্রো ইয়েফিমেনকোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের শুরুতে ডান হাত ভেঙে ফেলেন। ভেবেছিলেন, তাকে সেনাবাহিনী থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু গত জুনে ডাক্তার দেখাতে যাবার সময় পুলিশ তাকে আটকায়। এরপর এক সশস্ত্র ব্যক্তি তাকে জোর করে সেনা নিয়োগ কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
পরের দিন পঙ্গুত্বের জন্য ছাড়া পেলেও ঘটনাটি ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সেনা ইউনিফর্ম পরা লোকজন প্রতিষ্ঠানে আসে, পুরুষদের ফোন কেড়ে নেয়, তারপর তাদের রিক্রুটিং অফিসে নিয়ে গিয়ে জোর করে কিছু একটাতে সই করায়।
সেনা নিয়োগের জন্য ইউক্রেনের আরও মরিয়া হয়ে ওঠা প্রমাণ করে যে দেশটির সেনা-সম্পদ সীমিত এবং ২২ মাসের যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। এতে করে কেউ আর যুদ্ধে যেতে চাইছে না। দেশটির সরকার নিজেই স্বীকার করেছে যে, বহু মানুষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টা করছে।
রুশ অভিযান শুরুর পর থেকে কিয়েভ ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি পুরুষদের দেশত্যাগ করতে দেয়নি। তখন থেকেই দেশটির সরকার নিয়মিত সেনাভর্তি করছে। যুদ্ধের শুরুতে স্বেচ্ছাসেবী সেনার অভাব হয়নি। এখন সেই চিত্রের বিপরীতে গায়ের জোরে লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর লোকজন।
কিয়েভের এক আইনজীবী জানান, আগে একটি সেনা রিক্রুটিং সেন্টার ১৫ থেকে ২০ জনের নাম আসত যুদ্ধে নাম লেখাতে। এখন একটিও আবেদন আসে না। তবে এজন্য ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর দুর্নীতিও আছে। বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে সেনা হতে হয় বলেও অনেক অভিযোগ সামনে এসেছে।
এখন সেনাবাহিনীতে নিয়োগকারী কর্মীদের ‘মানুষ ছিনতাইকারী’ নামেই পরিচিত। এসব কর্মীরা ইউক্রেনীয় নাগরিকদের পাসপোর্ট জব্দ করে, সড়ক থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে, ড্রাফট কাগজে সই নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নতুন সৈনিক জোগাড় করছে বলে জানিয়েছেন দেশটির বহু নাগরিক।
ইউক্রেনের অভিযান চালাতে গিয়ে রুশ সেনাবাহিনীকেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও সেনা হতাহতের ঘটনা মেনে নিতে হচ্ছে। তবে তার চেয়েও বহু গুণ বেশি হচ্ছে ইউক্রেনকে। গেলো গত আগস্ট পর্যন্ত মার্কিন হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত যুদ্ধে ৭০ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
Leave a Reply