শিরিন শারমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদক প্রথম বুলেটিন
মায়ের সঙ্গে একজনের সম্পর্ক ছিলো। মা সম্পর্কের কথা গোপন করেন নি। তিনি বাবা মাকে অর্থাৎ আমার নানা নানীকে বলেছিলেন। নানী সম্পর্ক মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু নানা মেনে নেন নি। বরঞ্চ তিনি ক্ষেপে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে অন্য একজনের সাথে অর্থাৎ আমার বাবার সাথে মায়ের বিয়ে ঠিক করলেন। মা স্বাভাবিক কারণেই নানার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হলেন না। নানীও রাজি হলেন না।
কিন্তু নানা ধমক দিয়ে নানীকে চুপ করালেন আর মাকে ডেকে বললেন,”তুই কি তোর মাকে ভালোবাসিস?”
মা বললেন,”বাসি।”
এরপর নানা যা বললেন তা অকল্পনীয়।
নানা বললেন,”তুই যদি আমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে না করে তোর পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করিস তাহলে তোর মাকে আমি তালাক দেবো।”
মা হতভম্ব হয়ে নানার দিকে চেয়ে রইলেন। এবং ভাবলেন, একজন বাবা কী করে এতোটা বর্বর হয়?
নিরুপায় হয়ে মা বিয়েতে রাজি হলেন।
এরপর মা যখন তার পছন্দের মানুষকে বললেন, কী কারণে তিনি অন্য একজনকে বিয়ে করছেন, মানুষটি মা’র কথা বিশ্বাস করলো না।
ক্রুদ্ধ হয়ে মাকে বললো,”সিনেমার কাহিনী শোনাচ্ছো আমাকে? আসল কথা বললেই তো পারো যে, পয়সাওয়ালা ছেলে পেয়ে আমাকে আর ভালো লাগছে না। তুই একটা প্রতারক…।”
মাকে আরো অনেক গালমন্দ করে মানুষটি চলে গেলো। মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চোখের পানি ফেললেন।
বুক ভাঙা কষ্ট নিয়ে মা’র বিয়ে হয়ে গেলো। এখানে বলে রাখা দরকার, বাবা বিয়ের আগে থেকে মায়ের সম্পর্কের কথা জানতেন। জেনেশুনে মাকে বিয়ে করেছেন।
মা বাবাকে ঠকাতে চান নি। তাই কষ্টদায়ক অতীত জোর করে সরিয়ে রেখে মা মনোযোগ দিয়ে সংসার করতে লাগলেন। কিন্তু বাবা মাকে ঠকালেন। সে কথা একটু পর বলছি।
বাবা যদিও ধনীর ঘরের ছেলে ছিলেন, কিন্তু বিয়ের সময় তার ব্যবসায়ের অবস্থা ভালো ছিলো না। মাকে বিয়ে করার পরই বাবার ভাগ্যের চাকা সচল হয়ে গেলো। বাবা তরতর করে উপরে উঠে গেলেন। এর মধ্যে আমার জন্ম হলো। আমি তাদের একমাত্র মেয়ে।
এবার বলি বাবা কী করে মাকে ঠকালেন। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তাম, তখন আমার জন্য এক গৃহশিক্ষিকা রাখা হলো। গৃহশিক্ষিকার পরিবারের সাথে ব্যবসায়িক সূত্রে বাবার পরিচয় ছিলো। গৃহশিক্ষিকার এক ডিভোর্সি বড়ো বোন ছিলো। বাবা ঐ ডিভোর্সি মহিলাটির সাথে গোপনে সম্পর্ক গড়ে তুললেন।
মা অনেক দিন পর্যন্ত বাবার এই অবৈধ সম্পর্ক ধরতে পারেন নি। পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে মা জানতে পারলেন।
এরপর মা যখন বাবাকে অবৈধ সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তখন সরাসরি অস্বীকার করলেন।
এবং বললেন,”ঐ মহিলাটির সাথে আমার আপত্তিকর কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যবসার প্রয়োজনে মহিলাটির সাথে মিশতে হয়। আমি তাদের জমি বিষয়ক ঝামেলাগুলো সমাধান করে দিচ্ছি। বিনিময়ে বড়ো অংকের টাকা দিচ্ছে তারা আমাকে।”
কিন্তু মা যখন প্রমাণসহ বললেন, তাদের কোথায় কোথায় দেখা গেছে, এবং কী অবস্থায় দেখা গেছে, তখন বাবা নিজের দোষ ঢাকার জন্য রেগে গিয়ে মাকে বললেন,”তুই যদি শরীর বিক্রি করেও প্রতি মাসে এক লাখ টাকা এনে দিতে পারিস, তাহলে ঐ মহিলার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেবো। আর না পারলে একদম চুপ থাকবি।”
কথা শুনে মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ঠিক ঐ মুহূর্তে মা বুঝে গেলেন, ভুল মানুষের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। আর এটাও বুঝলেন, তিনি যদি সংসার ছেড়ে চলে যান, তাহলে তার বদরাগী বাবা, অর্থাৎ আমার নানা তাকে সমর্থন দেবেন না। উল্টো দোষারোপ করবেন। তখন নিজের বাবার বাড়িতে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। আর যেহেতু তার আয় নেই, সেহেতু আলাদা থাকাও সম্ভব নয়। মা তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাবার সংসার থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেন না।
তাই বলে মা হাল ছেড়ে দেন নি। ঐ দু:সময়ে মা উপলব্ধি করলেন, তার বাঁচার পথ একটাই, তা হলো স্বাবলম্বী হওয়া।
জীবনের দীর্ঘ সময় পর মা পুনরায় পড়াশোনা আরম্ভ করলেন। বাবা যখন তার অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন, মা তখন সীমাহীন কষ্ট নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন।
আমি যখন অনার্সে পড়ছিলাম, মা তখন মাস্টার্স শেষ করলেন। মোটামুটি ভাবে শেষ নয়, বেশ ভালো ভাবে শেষ করলেন। তারপর চাকরিতে ঢুকলেন।
মায়ের পড়াশোনা নিয়ে বাবার আপত্তি ছিলো না। কিন্তু চাকরি করার ব্যাপারে বাবা ঘোরতর আপত্তি করতে লাগলেন। তিনি কোনো ভাবে মাকে চাকরি করতে দেবেন না। আর মাও চাকরি ছাড়তে নারাজ। হয়তো বাবা টের পেয়েছিলেন যে, মা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে তাকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না।
বাবার অবৈধ সম্পর্ক এবং মাকে চাকরি করতে বাধা দেয়া, এই দুটো কারণে বাবা মা’র মধ্যে প্রতিদিন তুমুল ঝগড়া হতে লাগলো। একদিন বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে মা’র গায়ে হাত তুললেন।
সেদিনই চোখের পানি ফেলে মাকে বললাম,”মা, আপনি বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। এই সংসারে থাকলে আপনি মরে যাবেন।”
মা আমার কথা রাখলেন। এবার বাবার সংসার থেকে বেরিয়ে যেতে মা ভয় পান নি। কারণ মা তখন আয় করছেন।
স্বামীর সংসার থেকে বেরিয়ে মা আমাকে নিয়ে যখন নিজের বাবার বাড়িতে অর্থাৎ আমার নানার বাড়িতে এলেন, নানা তখন প্রত্যাশিত ভাবে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে মাকে বললেন,”সব দোষ তোর। পুরুষদের টুকটাক চরিত্রের সমস্যা থাকে। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কী আছে?”
মা তখন বললেন,”আপনারও কি চরিত্রের সমস্যা আছে?”
“চুপ থাক বেয়াদব মেয়ে।”
“চুপ থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে। আপনি যে শুধু আমার জীবনের বড়ো একটা অংশ ধ্বংস করেছেন তা নয়, মায়ের জীবনও ধ্বংস করেছেন। কিন্তু আর নয়। আমি নিজে এক নষ্ট পুরুষের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছি। এবার মাকেও আরেক নষ্ট পুরুষের শৃঙ্খল থেকে বের করে নিয়ে আসবো।”
এরপর মা নানীকে বললেন,”মাগো, আমি বাবার বাড়িতে থাকতে আসি নি। এসেছি আপনাকে নিয়ে যেতে। বাবা আপনাকে সব সময় তালাকের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখতেন। কিন্তু এবার সময় এসেছে জবাব দেয়ার। এবার সত্যি তালাক হবে। তবে আপনি বাবাকে তালাক দেবেন।”
কথাগুলো শুনে নানা হতবাক হয়ে গেলেন। সর্বস্ব হারানো মানুষের মতো তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আমি, মা এবং নানী যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, নানা তখন বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।
এবার আসি বাবার প্রসঙ্গে। মা’র সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর বাবা ঐ মহিলাকে বিয়ে করলেন। প্রথম প্রথম বাবার নতুন সংসার বেশ ভালো যাচ্ছিলো। কিন্তু বছর না পেরুতেই শুরু হলো বাবার পতন। ব্যবসায় একের পর এক মার খেতে লাগলেন। এবং মোটা অংকের ঋণে জর্জরিত হয়ে গেলেন। আর্থিক সংকট যখন দেখা দিলো, তখন বাবার দ্বিতীয় সংসারেও সংকট দেখা দিলো। ঝগড়া বিবাদ হতে হতে এক সময় তাদের সংসার ভেঙে গেলো।
ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়াতে ব্যাংক বাবার অবশিষ্ট সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলো। এবং তার নামে মামলা দিলো। বাবাকে যেদিন পুলিশ গ্রেফতার করেছিলো তার আগের দিন রাতে বাবা মা’র কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন। মা কিছু বলেন নি। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবা ঘরে ঢোকেন নি। হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে দরোজা থেকেই চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে বাবাও নানার মতো হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন।
মায়ের জীবন থেকে যে দুটো জিনিস শিখেছি তা হলো, এক. দু:সময়ে হাল ছেড়ে দিতে নেই , দুই. মেয়েদের জীবনে বিয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাবলম্বী হওয়া।
আর আমি তাই হবো। ঠিক মায়ের
যারা আইডি ফলো না করে গল্প পরছেন নীল লেখায় চাপ দিয়ে আইডি ফলো করেন আইডির গল্প গুলো মন ছুঁয়ে যাবে 👉👉 কথা কাব্য
Leave a Reply