*
রহিদুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার, রূজশাহীঃ
রেলওয়েতে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে ঘটছে হত্যাকান্ড-, চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা । চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। পাশাপাশি রয়েছে হাত ধরে টানাটানি ও গামছা পার্টির দৌরাত্ম্য। এছাড়াও চলন্ত ট্রেনে ঢিল মেরে লোকজনকে আহত করার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
জানা গেছে, রেলওয়ের ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ৭০০ কিলোমিটার পথই অরক্ষিত। সেখানে নেই কোনো ধরনের নিরাপত্তা। আন্তঃনগর ট্রেনে থাকে না কোনো পুলিশ সদস্য। এমনকি দেশের বেশিরভাগ স্টেশনেই নেই আর্চওয়ে। এই সুযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই সব ট্রেনে মাদকের চালান বহন করছে চোরাকারবারিরা।
অভিযোগ আছে, ওইসব কারবারির সঙ্গে সখ্য আছে আইনপ্রয়োগকারীর সংস্থার সদস্যের সঙ্গে। রেল পুলিশ বলছে, মাত্র ২ হাজার ৪৩২ সদস্য দিয়ে রেলের এলাকাগুলোতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এলাকাভিত্তিক নানা ধরনের উদ্যেগ নেওয়া হচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে নিরাপত্তা ভালোভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রেলওয়ে পুলিশের প্রধান বলেন,রেলের নিরাপত্তা দিতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। ট্রেনে ঢিল পার্টির সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয়দের নিয়ে পুলিশ উঠোন বৈঠক করছে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রেল পুলিশের জনবল তুলনামূলক কম। তবে কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছে, রেলওয়ে পুলিশে জনবল বাড়ানো হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণম যেসব রাস্তা রয়েছে সেখানে পুলিশের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের কোনোম সদস্য অপকর্মে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, পূর্ব ও পশ্চিম মিলে ২৪ ঘণ্টায় দেশের চারটি সেকশনে তিন শতাধিক এক্সপ্রেস, মেইল, লোকাল ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করছে।
এদিকো, বর্তমানে ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। তার মধ্যে অন্তত ৭০০ কিলোমিটারই আছে অরক্ষিত। ওইসব এলাকায় রাতের বেলা নির্জন ও অন্ধকারে ঢাকা থাকে। এমনকি দিনের বেলায় নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। বিশেষ করে রাতের বেলায় সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী ও পেশাদার অপরাধীসহ অন্যান্য দুষ্কৃতকারী ট্রেনের ভেতর অথবা বাইরে কোথাও কাউকে হত্যার পর লাশ গুম করতে এসব অন্ধকার ও নির্জন এলাকা বেছে নিচ্ছে। অরক্ষিত রাস্তাগুলো নিয়ে পুলিশের একটি সংস্থা অনুসন্ধান করেছে। তাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী পাকশীর আবদুলপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আমনুরা, হাতিবান্ধা, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, ললিতনগর, সান্তাহার, কাউনিয়া, চাটমোহর, বালাসী, পোড়াদহ, কালুখালী, দৌলতদিয়া, নওয়াপাড়া, রহনপুর, দর্শনা, নাটোর, ঢাকার কমলাপুর, বিমানবন্দর, আখাউড়া, ভৈরব, বি-বাড়িয়া, লাকসাম, ফেনীর ফতেহপুর, সিলেটের ছাতক, ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, শমসেরনগর, শায়েস্তাগঞ্জ, নতুনবাজার, টঙ্গী, কুমিল্লা, ঘোড়াশাল, লাকসাম, মীরসরাইসহ আরও কয়েকটি এলাকাসহ অন্তত ৭০০ কিলোমিটার এলাকায় নেই কোনো নিরাপত্তা।
এছাড়া খুলনা বিভাগের খুলনা জেলার ১৫টি পয়েন্ট, যশোর জেলার ২৩টি পয়েন্ট, ঝিনাইদহের ১৮টি পয়েন্ট, খুলনা রেলস্টেশন থেকে শুরু করে খালিশপুর থানাধীন জংশন রেল ক্রসিং, মুজগুন্নী রেল ক্রসিং, দৌলতপুর থানাধীন বিজিবি গেট, বিদ্যুৎ অফিস, দৌলতপুর বাজার ক্রসিং, রেলগেট ক্রসিং, খানজাহান আলী থানাধীন ফুলবাড়িগেট ক্রসিং, শিরোমণি স্টেশন, কনডম ফ্যাক্টরি, ইস্টার্ন জুট মিলগেট, ফুলতলা থানাধীন ফুলতলা রেলস্টেশন, গাড়াখোলা রেলগেট, রাড়ীপাড়া ক্রসিং, যুগ্নীপাশা ক্রসিং, যশোরের অভয়নগর, রাজঘাট, তালতলা, নওয়াপাড়া, ভাঙ্গাগেট, চেঙ্গুগুটিয়া বাজার, প্রেমবাগগেট, প্রেমবাগ মোড়, বুসন্দিয়া, বসুন্দিয়া স্ট্যান্ড, সিংগিয়া, হাটাবিলা, রূপদিয়া বাজার, গোপালপুর স্ট্যান্ড, রাজারহাট রেল ক্রসিং, মুড়ালী, শংকরপুর, মুজিব সড়ক, খোরাডাঙ্গা, ধর্মতলা, চুরামনকাঠি রেল ক্রসিং, শানতলা, বারীনগর, মান্দারতলা, ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুরের সুয়াদী রেল ব্রিজ থেকে শুরু করে সাবদারপুর রেলস্টেশন, শালকেপা রেলগেট, রাজাপুর রেলগেট, বিদ্যাধরপুর রেলগেট, ফুলবাড়ি রেলগেট, বড় বামনদহ রেলগেট, রাঙ্গিয়ার পোতা রেলগেট, চাঁদপাড়া রেলগেট, সুন্দরপুর রেলগেট, কালীগঞ্জের বারোবাজার রেল সেতু, বারোবাজার রেলস্টেশন, চাঁচড়া মাঠ, রঘুনাথপুর সেতু, বারোবাজার রেলগেট, ২৭নং ব্রিজ হাজিপুর মুন্দিয়া, ২৫নং ব্রিজ রঘুনাথপুর, সুন্দরপুর রেল সেতু নং ৩৭ ও মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনও প্রায়ই অরক্ষিত থাকে বলে পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, রেলওয়ে কোনো স্টেশনেই স্ক্যানিং মেশিন নেই। ফলে সন্দেহজনক যাত্রীদের তল্লাশি করা দুরূহ হয়ে যায়। তার ওপর রয়েছে লোকবল স্বল্পতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশনসহ প্রয় সব স্টেশনে একাধিক রাস্তা থাকায় যত্রতত্র লোকজন ট্রেনে উঠছে। যাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে চোরাকারবারিরাও। তাদের শনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, অরক্ষিত রেলওয়ের রাস্তাগুলোতে নিরাপত্তা বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এমনকি ওইসব স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা যায় কি না তাও ভাবা হচ্ছে। তবে এটি ব্যয়বহুল।
অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ ট্রেন দিয়ে মাদকের চালান আসছে। মাদকের চালান নিয়ে আসা হচ্ছে রাজধানীতে। লাকসাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলাসহ সীমান্তবর্তী এলাকা হয়ে আসা যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে প্রকাশ্যে মাদক বহন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তুর্ণা নিশিতা, মহানগর প্রভাতী, চট্টগ্রাম মেইল, ওয়ান-আপ, সিলেট থেকে ছেড়ে আসা পারাবত, জয়ন্তিকা, উপকূল, কুশিয়ারা, বাল্লা, আখাউড়া থেকে ছেড়ে আসা ডেমু ট্রেনগুলো সীমান্ত এলাকায় যত্রতত্র স্টেশনবিহীন দাঁড়িয়ে পড়ে। কখনো আবার চলে ধীরগতিতে। ওই সময় বস্তায় ভরে মাদকের চালান ট্রেনে তোলা হয়। ত্রিপুরা সীমান্ত হয়ে আসা মাদকের চালান কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলাসংলগ্ন রেলপথ দিয়ে ট্রেনে তোলা হয়।
বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার জংশন স্টেশনে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন ট্রেনে খোয়া যাচ্ছে যাত্রীদের মুঠোফোন, টাকাসহ সোনার গহনা। যাত্রীদের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো রেলপুলিশকে জানানো হলেও বন্ধ হচ্ছে না অপরাধীদের তৎপরতা। আবার নারীরা শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন বলেও অহরহ অভিযোগ আসে। সান্তাহার জংশন স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন ১৬ জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। কয়েক হাজার যাত্রী নিয়মিত এ স্টেশন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্টেশনে যাতায়াত করে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য স্টেশনে একটি পূর্ণাঙ্গ রেলওয়ে থানা ও নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে। ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, পকেটমার, ছিনতাইকারী ও বখাটেদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রুখতেই পারছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
প্ল্যাটফর্মে মাদকসেবীদের তৎপরতা থাকে সবসময়। সেখানে বসেই মাদক সেবন করে তারা। স্টেশনে আসামাত্র ভিড় করে বখাটেরা। ট্রেনে ওঠার সময় নারী যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। অপরাধীদের নেতৃত্ব দেওয়া একটি চক্র সার্বক্ষণিক স্টেশন এলাকায় অবস্থান করে। চক্রগুলোর সঙ্গে রেলপুলিশের আঁতাত রয়েছে।
এদিকে, পশ্চিম রেলওয়ের স্টেশনের কর্মকর্তা বলেন, মাঝেমধ্যে রেলওয়ের সম্পদ উদ্ধার, রক্ষা ও দুষ্কৃতকারীদের হামলায় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও রেলওয়ে পুলিশের সদস্যরা মারা যাচ্ছেন। আবার কেউ আহত হচ্ছেন। অনেক পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ অনুযায়ী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বছরখানেক আগে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ঢাকাগামী কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তরা পাথর নিক্ষেপ করে। এ সময় পাথরের আঘাতে ইঞ্জিন কামরার জানালার কাচ ভেঙে সহকারী ট্রেনচালকের দুই চোখে বিদ্ধ হয়। তিনি গুরুতর আহত হন। তার একটি চোখ প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ রোধে সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ক্যাম্পেইন কর্মসূচি পালন করা যেতে পারে। প্রতিটি মসজিদে জুমার বয়ানে ইমামদের এ বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করতে পারে। পাশাপাশি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা জোরদার করা, রেলের জনবল বাড়ানোসহ বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতিটি ট্রেনে রেলওয়ে পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলওয়ে পুলিশকে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অপরাধী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন (১৮৯০) এর ১২৭ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। আইনে বলা আছে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। আর কোনো রেলযাত্রী মারা গেলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ফাঁসির বিধান ও পাথর নিক্ষেপকারী অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে সে ক্ষেত্রে তার অভিভাবককে শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধে সমাজের পাশাপাশি পরিবারেরও সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি এর কুফল নিয়ে আলোচনা করে সবাইকে সচেতন করতে হবে।